করোনাভাইরাস-এর আবির্ভাব গত ডিসেম্বর থেকে চীনে শুরু হলেও সারা পৃথিবীতে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয় মূলত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি থেকে। বাংলাদেশে বলতে গেলে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মিডিয়ায় এর ওপর রিপোর্টিং সবার চোখে পড়ার মতো করে আসতে থাকে। ভাইরাসটির আকার এতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে তা দেখতে অত্যন্ত শক্তিশালী অনুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। তা এ হেন অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নস্যি কণা— যা ধূলিকণারও অধম আকারের দিক থেকে, সে কীভাবে হাতি হয়!
জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে চীন, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, জাপান, কোরিয়া, এমনকি কিউবা, ব্রাজিল, ভারত, অষ্ট্রেলিয়া ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাইরোলজিস্ট, ডাক্তার, ওষুধ কোম্পানি থেকে শুরু করে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (হু) সবার থেকে এই ভাইরাসটি কীভাবে ছড়ায়, মানুষকে কীভাবে কাবু করে এবং এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, সে সম্পর্কে অনেক নির্দেশনা, অনেক গবেষণার ফলাফল আমরা এই যুগের মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিদিনই পাচ্ছি। এত ধরনের মতামত এসেছে যে প্রায় সময়ই দেখা যাচ্ছে একজনের মতের সঙ্গে অন্যের অভিমত মিলছে না। এমনকি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে হু যে স্বাস্থ্য নির্দেশনা দিয়েছে, তা থেকে পরে প্রতিষ্ঠানটি সরে এসেছে। এটা শুধু হু না, ভাইরোলজিস্ট, বায়োলজিস্ট, ডাক্তার, মহামারি বিশেষজ্ঞ সবারই একই অবস্থা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রথমে হু-এর কাছ থেকে নির্দেশনা এসেছে যে কেবল আক্রান্ত ব্যক্তিরাই মাস্ক পরবে। এখন সেটা উলটে গেছে। ঠিক তেমনি জাপান ও কোরিয়ায় প্রচলিত কিছু ওষুধ, অথবা ভারতের হোমিওপ্যাথিক অথবা ভেষজ কোনো ওষুধ কীভাবে কার্যকর বলে রায় দেওয়া হলো এবং পরবর্তী সময়ে তা নাকচ করা হলো, এগুলোও আমরা দেখতে পাচ্ছি। টিকা আবিষ্কারের কিছু ভবিষ্যদ্বাণী আমরা পাচ্ছি, কিন্তু এখনো কোনো কার্যকর টিকা আবিষ্কৃত হয় নি। কবে হবে তাও জানতে পারছি না। অনেকে আন্দাজের উপর নির্ভর করেই কথা বলছেন। এই অবস্থা দেখে আমরা অন্ধের হাতি দেখার গল্প মনে করতে পারি।
অন্ধের হাতি দেখার মতোই করোনা সম্পর্কে যে যতটা জেনেছে, সে ততটা বলছে। করোনার অবয়ব, গঠনপ্রণালি, কীভাবে এটি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়, মানুষের ভিতরের কোন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কীভাবে বিকল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, তার সার্বিক চরিত্র ইত্যাদি সম্পর্কে আমরা এখনো কোনো সুস্পষ্ট চিত্র পাচ্ছি না। এখনো এটি অন্ধের হাতি দেখার মতো অবস্থাতেই রয়ে গেছে।
আমরা ছোটবেলা থেকে ‘গরিবের দ্বারে হাতির পা পড়া’ প্রবাদটি জানি। এটি হয়ত এ কারণে এসেছে যে, আগের দিনে রাজা-জমিদাররা কোনো দরিদ্র প্রজার উপরে কোনো কারণে ক্ষিপ্ত হলে প্রজার বাড়িতে এক সপ্তাহ বা এক মাসের জন্য হাতি পাঠিয়ে দিতেন। রাজা বা জমিদারের হাতির যত্ন-আত্তি সঠিকভাবে বা রাজা/জমিদারের মান অনুযায়ী করতেই হবে। গরিবের জন্য এটা যে কত বড়ো শাস্তি তা কে না বুঝতে পারে! রাজার হাতি প্রতিপালন করতে গিয়ে দরিদ্র প্রজার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ত। একইভাবে করোনাভাইরাস মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র মানুষের দ্বারে পা রাখায় তার জীবন ও জীবিকা দুইই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে। এই হাতি এমন হাতি, সে যে দিক দিয়েই যাচ্ছে, তা সে রাজার বাড়ি হোক বা প্রজার বাড়ি হোক, রাজার ফুলবাগান হোক বা প্রজার পর্ণকুটির হোক, তার পায়ের নিচে সকলই ধূলিস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বা চীন-জাপানের মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রও এই হাতির পায়ের নিচে পর্যুদস্ত। আর আমাদের মতো দেশের অবস্থা কী তা তো আমরা নিজেরাই দেখছি। এখন আর কোনো প্রেসিডেন্ট বা রাজা অথবা কোনো বড়োলোকই এই হাতিকে তাদের দরজায় রেখে গৌরব বা সম্মানিত বোধ করবেন না।
এই হাতি এমন হাতি যার কোনো মাহুত দরকার পড়ছে না, বল্লম দরকার পড়ছে না, যুদ্ধাস্ত্র দরকার পড়ছে না। এমনকি তার কারো প্রতি ‘খামোশ’ শব্দটিও উচ্চারণ করতে হচ্ছে না। তারপরও সারা পৃথিবীই তার কাছে খামোশ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এই কানোভাইরাসটিকে হাতির চেয়ে কম বলা যাচ্ছে কি?
এবার আসা যাক করোনাভাইরাস-এর মোকাবেলা প্রসঙ্গে। এই ভাইরাস মোকাবেলা করার জন্য যেহেতু কোনো ধরনের অস্ত্র, অর্থাৎ কোনো টিকা এখন পর্যন্ত আমাদের হাতে এসে পৌঁছায় নি, কাজেই আমাদের নিজ বাড়ির দুর্গে অবস্থান করতে হচ্ছে এবং ঘরের বাইরে বের হলে প্রয়োজনীয় বর্ম, অর্থাৎ মাস্ক, পিপিই, স্যানিটাইজার ইত্যাদি পরিধান করতে হচ্ছে। বলা হচ্ছে, শারীরিক সক্ষমতা তথা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে, মনোবল চাঙ্গা রাখতে, সবসময় হাত সাবান-পানি বা স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণুমুক্ত রাখতে, মাস্ক পরতে এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে। জানানো হচ্ছে, যতক্ষণ করোনার প্রতিষেধক না পাওয়া যাচ্ছে, ততদিন এভাবেই জীবনযাপন করতে হবে; এবং এগুলোতেও যখন তেমন কাজ হচ্ছে না, তখন সম্পূর্ণ ‘লকডাউন’-এ থাকতে হচ্ছে বা হবে।
অনেকে ঠাট্টা করে বললেও বিষয়টি অতি সত্যি যে পুরুষতান্ত্রিক ভাইরাসের দাপটে নারীরা সারাজীবন বাড়ির ভিতরে লকডাউন অবস্থায় থাকে। এই লকডাউন অবস্থায় থাকা সত্তে¡ও পুরুষতন্ত্রের ভাইরাস দ্বারা ঘরের ভিতরে নারীদের জখম হতে হয়, প্রাণ দিতে হয়। আবার বাড়ির বাইরে বের হতে হলে এই ভাইরাস থেকে রক্ষা পাবার জন্য হিজাব, স্কার্ফ, বোরকা ইত্যাদি পিপিই পরেও অনেক সময় তাদের শেষরক্ষা হয় না। তারা যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ইত্যাদির শিকার হন, এমনকি তাদের প্রাণও দিতে হয়।
কার্যকর টিকা না আসায় করোনাভাইরাস থেকে রক্ষায় যেমন শরীরের ইমিউনিটি বাড়ানো, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও শরীরচর্চার কথা বলা হচ্ছে, তেমনি পুরুষতান্ত্রিকতার ছোবল থেকে নারীসমাজের রেহাই বা মুক্তির জন্যও তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, যার অপর নাম এমপাওয়ারমেন্ট, তার উপরে জোর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পুরুষতন্ত্রকে নির্মূল করার জন্য যে ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ কার্যকর ওষুধ, সে সম্পর্কে সারা পৃথিবীর নীতিনির্ধারকরাই কোনো কথা বলছেন না। বরং নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর দক্ষতা বা স্কিল ইত্যাদি বাড়ানোর মধ্যেই মূলত সীমাবদ্ধ থাকছেন।
কারোনাহাতির দাবড়ানি খেয়ে এ বিষয়ে আমাদের চোখের পর্দা যদি কিছুটা হলেও সরে এবং নারীর জীবন লকডাউন থেকে মুক্তি পায় সে কামনাই শুধু করতে পারছি।