গত শতকের ষাটের দশকের প্রথম ভাগে আমরা যখন ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমাদের বিভিন্ন ব্যাখ্যা লিখতে হতো। তার মধ্যে একটি ছিল ‘গ্রিক সভ্যতা ক্রীতদাসদের দান’, আরেকটি ছিল ‘রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন এ ডে’ (গরুর রচনা লেখার পাশাপাশি)। শুধু গ্রিক সভ্যতা বা রোমের গড়ে ওঠা না, তাজমহল থেকে শুরু করে পিরামিডসহ পৃথিবীর যেসব বড় বড় স্থাপনা, বড় বড় স্কাল্পচার তৈরি হয়েছে, যাকে আমরা ‘সভ্যতা’র নিদর্শন বলি, এর সবই ওই দাসদের দান। এমনকি আমরা যেটাকে সভ্যতার যুগ বলি, সেই যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সম্পদশালী হয়েছে এবং বর্তমানে দেশটিতে যতটুকুই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেখানেও ক্রীতদাসদেরই অবদান।
এই কথাটি মনে পড়ল সম্প্রতি ডেইলি স্টারে বিজিএমইএ’র সভাপ্রধান ড. রুবানা হকের একটি বিবৃতি দেখে। বিবৃতিটি উনি দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক নির্যাতন, শ্রমিক শোষণ এবং করোনার সময়েও শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের অমানবিক আচরণের যে অভিযোগ বিভিন্ন পক্ষ থেকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, সেই অভিযোগ খণ্ডনের উদ্দেশ্যে। বিবৃতির শেষ দিকে উনি যা লিখেছেন তা বাংলায় সংক্ষেপে তর্জমা করলে দাঁড়ায়— ‘পোশাক শিল্পের মালিকরা বা বিজিএমইএ কখনো ‘নিও লিবারালিজম’ সাপোর্ট করে না, শ্রমিকদের শোষণ বা নির্যাতন করে না।’ আমরা জানি, রুবানা হক একজন সফল ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাই শুধু নন, তিনি অত্যন্ত মেধাবী এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারী; অত্যন্ত ভদ্র এবং খুব মেপে কথা বলেন। ‘আকলমন্দ কে লিয়ে ইশরায় কাফি’, এই সূত্রে আমি আমার বক্তব্য খুব সংক্ষিপ্ত (মিনি) আকারেই বলছি :
তিনি নিজেই জানেন, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে প্রফিট, সারপ্লাস ভ্যালু বা উদ্বৃত্ত মূল্যের যে থিউরি, যা কার্ল মার্কস বলে গেছেন; সেটা প্রমাণ করার জন্য পদ্ধতি অর্থনীতিবিদ বা রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার দরকার নেই। মোটাদাগে বলা যায়, আমরা দেখেছি বাংলাদেশের পোশাকশিল্প অতি অল্প সময়ে কীভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছে। এই ফুলেফেঁপে ওঠার জন্য অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে যে প্রফিট অ্যাকিউমুলেটেড বা পুঞ্জীভূত হয়েছে, তার পিছনে শ্রমিকদের শ্রম শোষণই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। যেমন মোটাদাগে বলা যায়, এই শিল্পের যত মেশিনারিজ এবং কাঁচামাল দরকার, তার নগণ্য অংশ বাদ দিয়ে প্রায় সবই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তার জন্য যে মূল্য তা পাই পয়সা হিসেবে পরিশোধ করেই সেগুলো আমদানি করতে হয়। তাহলে তাদের প্রফিট বা লাভটা কোথা থেকে আসে? এটা সকলেই জানে যে, শ্রমিকদের কম বেতন দিয়ে যে মার্জিনটা থাকে সেখান থেকেই এই প্রফিটটা আসে। তারা যে দাবিটা করেন যে তারা লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে, বিশেষ করে নারীদের চাকুরির সংস্থান করে দিয়েছেন, সেটা তাদের প্রতি দয়া বা নারী অধিকারের প্রতি সম্মানবোধ থেকে নয়, বরং কিছুটা কম ঝামেলায় তাদের কম বেতন দিয়েই পার পাওয়া যাবে এই বিবেচনাটাই এখানে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। আর লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে নিয়োগ না দিলে হাজার কোটি ডলার মুনাফা অর্জন করা যাবে না। সেই কারণেই তারা লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে নিয়োগ দিয়েছেন তাদের লাভের অংকটা বাড়ানোর জন্য।
আর বাজারে যে মিথটা চালু করতে তারা সফল হয়েছেন যে, গার্মেন্টস মালিকরাই এই দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং অর্থনীতিকে সচল রাখায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন এটা ঠিক নয়। এই বক্তব্য যুক্তির ধোপে টেকে না। কারণ আগেই বলেছি, মেশিনারিজ এবং কাঁচামাল সব বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় এবং সেটা বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধ করেই। সুতরাং বৈদেশিক মুদ্রা যেটা দেশে আসে সেটা শ্রমিকদের কম বেতন দিয়ে তারা যে প্রফিটটা পান, যে সারপ্লাস ভ্যালুটা তৈরি হয় সেটা থেকেই অর্জিত হয়। সুতরাং এখানে শ্রমিকের অবদানই প্রধান। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে প্রধান অবদান যে গার্মেন্টস মালিকদের নয়, এটা কেবল আমার বক্তব্য নয়; ড. হোসেন জিল্লুর রহমানও সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন। পৃথিবীতে ধনী দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং ধনীক সৃষ্টির যে দ্রুতগতি সেখানে বাংলাদেশের স্থান সামনের সারিতে, এটা কয়েক মাস আগে বৈশ্বিক জরিপের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত একটি রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে।
‘ও মা, রাজা ন্যাংটা’— এই গল্পটি আমরা অনেকেই জানি। নিউইয়র্কে করোনার করাল থাবা থেকে জনগণকে সুরক্ষা দেওয়ায় ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে নিউইয়র্কের গভর্নরের অতি সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য এই গল্পটিকে মনে করিয়ে দেয়। তার মন্তব্যটির সংক্ষিপ্ত তর্জমা হলো— ‘যুদ্ধের সময় যখন আমাদের ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা অর্থাৎ সৈনিকদের হাতে অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র ও মারণাস্ত্রের কখনো কোনো অভাব হয় না (যেমন বন্দুক, কামান, ট্যাংক, ফাইটার প্লেন, পারমাণবিক বোমা ইত্যাদি), সেখানে বর্তমানে করোনার মহামারি থেকে মানুষের জীবন বাঁচানোর যুদ্ধের যারা সম্মুখ সারির সৈনিক অর্থাৎ ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পিপিই, করোনা সনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় কীটের প্রচণ্ড অভাব দেখতে পাই। কারণ তার জন্য অর্থের কোনো সংস্থান নেই।’ তার এই বক্তব্য বর্তমানে প্রচলিত অর্থনীতি এবং ‘গণতন্ত্র’-এর নামে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার (গভর্নমেন্ট বাই দা পিপল, ফর দা পিপল, অব দা পিপল) আসল চেহারা কিছুটা হলেও উন্মুক্ত করেছে এবং এই প্রপঞ্চের অসারতা প্রমাণ করেছে, রাষ্ট্রের কোথায় প্রায়োরিটি তাকে অত্যন্ত প্রকটভাবে উন্মোচন করেছে। এটা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাকেই তুলে ধরে না, কিছু ব্যতিক্রম বাদে এটা গোটা পৃথিবীরই চিত্র।
করোনাকালেই আমরা দেখছি, বাংলাদেশে বক্স খাটের নিচে ‘ভোজ্যতেলের খনি’। এই ঐতিহ্যের গল্প যদিও এদেশে নতুন না, তবু এই গল্প আমাদের ‘মানুষের উপরে কখনো বিশ্বাস হারাতে নেই’— এই বক্তব্যের ভিত্তিকে আবারো প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়।
যা হোক, এই হতাশার মধ্যেও একটি ইতিবাচক সুর দিয়ে এই মিনিগল্পের ইতি টানি, সেটি হলো— বিশ্বে নারী নেত্বত্ব করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বেশি সাফল্য দেখিয়েছেন, যা আমরা বিশ্ব গণমাধ্যম থেকেই জানতে পেরেছি।