স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভুলে ভরা কথিত রাজাকারের তালিকাটি ইতোমধ্যে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, ১০ হাজার ৭৮৯টি নামসম্বলিত ওই তালিকায় অনেক রাজাকারের নামের অনুপস্থিতি থাকলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভাতাপ্রাপ্ত অনেক মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের স্ত্রীর নামও অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। ভীষণ অগোছালো ও ভুলে ভরা এই তালিকাটি নিয়ে দেশব্যাপী ক্ষোভের সঞ্চার হওয়ায় ও সর্বস্তরে সমালোচনার ঝড় ওঠায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তালিকাটি প্রত্যাহৃত হয়। এই তালিকা অনলাইনে প্রকাশের ফলে যেসব শহিদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার আহত হয়েছেন তাঁদের প্রতি সমবেদনাও প্রকাশ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। 

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরে জানিয়েছে তারা যাচাই-বাছাই করে আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সংশোধিত রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এ ধরনের একটি তালিকা তারা যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রকাশ করল কোন আক্কেলে? যাদের প্রাথমিক পর্যায়ের এটুকু কাণ্ডজ্ঞানই নেই, তাদের করা পরবর্তী তালিকাও যে নির্ভুল হবে জাতিকে সেই গ্যারান্টি কে দেবে, যেখানে এই মন্ত্রণালয় এখনো পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রহণযোগ্য তালিকা তৈরিতেও ব্যর্থ হয়েছে? ইতোমধ্যেই এই মন্ত্রণালয় দুর্নীতি, অসততা ও অদক্ষতার বিস্তর পরিচয় দিয়েছে, যার অজস্র প্রমাণ প্রকাশিত-প্রচারিত হয়েছে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে। 

আমরা মনে করি একাত্তরের রাজাকারদের নির্ভুল একটি তালিকা অবশ্যই তৈরি হওয়া দরকার। কিন্তু তারও আগে দরকার রাজাকারি মন চিহ্নিত হওয়া। রাজাকারের তালিকা তৈরি করবার আগে সরকারে ও প্রশাসনে থাকা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকারি মনওয়ালা নব্য রাজাকারগুলো চিহ্নিত করে অপসারণের উদ্যোগ না নিলে নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করা এই প্রশাসনের পক্ষে কস্মিনকালেও সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এমনকি সম্ভব হবে না একটি গ্রহণযোগ্য মুক্তিযোদ্ধা তালিকা তৈরি করাও। প্রকাশিত ও ইতোমধ্যে প্রত্যাহৃত ভুলে ভরা রাজাকারের তালিকায় ওই রাজাকারি মনেরই প্রতিফলন ঘটেছে। 

এটা খুবই পরিষ্কার যে, রাজাকারি মন-মানসিকতাধারী মানুষ ও চিন্তাচেতনা দিয়ে ভরা প্রশাসনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, কেবল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ অনেক মন্ত্রণালয়েই এ ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জাঁকিয়ে বসে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে বৈষম্যহীন একটি সমাজ গঠনের পথে এরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে। চাকুরির শর্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রের নাগরিকদের সব ধরনের সেবা দেবার জন্য এই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেও এরা নাগরিকদের নানাভাবে হয়রানি করে থাকে। যারাই তাদের কাছে কোনো না কোনো সেবার জন্য গিয়েছেন তাদের সিংহভাগকেই কোনো না কোনোভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। এমনকি জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করে যারা তাদের বড় কর্মকর্তা হবার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন, বিদ্যমান প্রশাসনের কাছ থেকে হয়রানিমুক্তভাবে কোনো সেবা পাওয়ার ঘটনা তাদের ক্ষেত্রেও বিরল। আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে নিজেদের আখের গোছানোর ধান্ধায় থাকা সরকারের একাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী নাগরিকদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধানে কোনোরূপ দায়িত্বই অনুভব করেন না, যদিও তারা নাগরিকদের ট্যাক্সের টাকায়ই বেতন পান। তাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বহুল পরিচিত একটা উক্তি মনে করিয়ে দিতে চাই। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘সমস্ত সরকারী কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যাতে কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন।’ বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ মান্য করে চললে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সেবার মান বাড়ত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা হয় নি। 

কখনো কখনো মনে হয় নাগরিকদের ইহজাগতিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য নির্দিষ্ট দায়দায়িত্ব পালনের চাইতে তাদের বেশি মনোযোগ থাকে ধর্মরক্ষায় এবং সেটা কেবল নিজেদের নয় বরং নাগরিকদেরও। তারা হয়ত জানেন না যে নাগরিকদের পরকালের মঙ্গল-অমঙ্গলের ব্যবস্থাপনা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের নয়। সুতরাং রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে তাদেরও নয়। এই অংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও প্রশিক্ষণে আমন্ত্রিত হয়ে যা বলেন তা থেকেও তাদের মানসিক গড়ন আন্দাজ করা যায়। পুরুষতান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন একটি ধর্মান্ধ মানসিকতার বীজ বিস্তার করে এরা কার্যত দেশকে ৭৫-এর ধারায় ফিরিয়ে নেবার জন্য কাজ করে চলেছে। এদের এই গতি রোধ করতে না পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়নসহ এসডিজির কোনো লক্ষ্যই সাফল্যের সাথে অর্জন করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা পরিচালিত হবে সংবিধান অনুযায়ী, শরিয়া আইন অনুযায়ী না। 

সার্বিক এই বাস্তবতায় রাজাকারের তালিকা তৈরি করবার আগে প্রশাসনের ভেতরে একটি শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা এখন সময়ের দাবি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে যেরকম দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান চলমান আছে, একইভাবে প্রশাসনের ভেতরে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে পদ অনুযায়ী নির্দিষ্ট দায়িত্বের প্রতি অমনোযোগী, দুর্নীতিবাজ ও রাজাকারি মানসিকতার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করে অপসারণের উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে প্রচুর পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করেও বিদ্যমান প্রশাসন দিয়ে যেমন কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হবে না, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সরকার পরিচালনার কাজটিও বারবার বাধাগ্রস্ত হতে থাকবে।  

ভুলে ভরা রাজাকারের তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে সরকারের একটি বিশেষায়িত মন্ত্রণালয় যেভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করল, তা সম্ভব হয়েছে রাজাকারি মানসিকতাসম্পন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মন্ত্রণালয়ের ভেতরে রয়েছে বলেই। এই শুদ্ধি অভিযানটি শুরু হতে পারে এই তালিকাসংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার মাধ্যমে। একটি গ্রহণযোগ্য ও স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে এই ঘটনার তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের প্রতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নাগরিকদের অনাস্থা তৈরি হবে। সরকার একটা ভাবমূর্তির সংকটে পড়বে। কাজেই এর একটা গ্রহণযোগ্য সুরাহা না করে বিদ্যমান প্রশাসনের মাধ্যমে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা বা রাজাকারের তালিকা তৈরির উদ্যোগ না নেওয়াই উত্তম বলে মনে করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *