২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার ভেতর দিয়ে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনের কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যেই গত ৩০ নভেম্বর শনিবার রাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ওএসডি) ড. জাকির হোসেন যৌতুকের দাবিতে তার চিকিৎসক স্ত্রীকে এমন নির্যাতন করেন যে তিনি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হন। অভিযোগ আছে, ওই অতিরিক্ত সচিব যৌতুকের দাবিতে তার স্ত্রীকে প্রায়ই নির্যাতন করতেন, যেজন্য তার শরীরে এর আগেই ৯টি সেলাই লেগেছে। শনিবার রাতে নির্যাতনের সময় ভিকটিম ৯৯৯-এ ফোন করলে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলে হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করে। পরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হলে অভিযুক্তকে পুলিশ গ্রেফতার করে। মামলার বাদী নির্যাতনের শিকার স্ত্রী পরে আদালতে মুচলেকা দিয়ে স্বামীর জামিন নেন।   

বিচার বিভাগ থেকে এই নির্যাতক অতিরিক্ত সচিব হয়ত মুক্তি পেয়ে যাবেন, বাদী স্ত্রী নিজেই যেহেতু স্বামীকে ‘একটি সুযোগ’ দিতে চেয়েছেন। কিন্তু ঘটনাটা তাতেই শেষ হয়ে যায় না। প্রশ্ন থেকে যায় যে, প্রশাসনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, যার দায়িত্ব রাষ্ট্রের আইন, নীতি ও কর্মপরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি বা কমিউমেন্টসমূহ বাস্তবায়ন করা, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের উদ্যোগসমূহকে সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, তাদেরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে বোঝাই যায় জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকার কতটুকুই বা বাস্তবায়ন হয় বা হবে। 

এই ধরনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যখন জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের একটি পদ অধিকার করে থাকেন, তখন এই আশঙ্কা খুব সংগতভাবেই করা যায় যে, নির্যাতনের শিকার স্ত্রী ক্ষমা করে দিলেও জনগণ তাকে ক্ষমা করতে পারবে কি না। প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার মাত্রা যদি এই পরিমাণ হয়, তবে প্রশ্ন উঠতে পারে যে সরকার নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারীর সমান অধিকার বাস্তবায়নের জন্য যে সব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, সেখানে কোনোভাবে অবদান রাখা এই ধরনের কর্মকর্তার পক্ষে সম্ভব কি না।  

সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন ১৩২৫-এর আওতায় নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা (ডব্লিউপিএস) অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। গত ২৪ নভেম্বর ২০১৯ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পরিকল্পনার উদ্বোধন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে আমি ধর্ম কীভাবে নারীর সমানাধিকার বাস্তবায়ন ও অগ্রযাত্রায়, বিশেষ করে নারীর চলাফেরা ও কাজে বাধা সৃষ্টি করে সে প্রসঙ্গ টানি। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, অনুষ্ঠানে প্রিভেনশন অব ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজিম নিয়ে কথা হচ্ছিল। অনুষ্ঠান শেষে চা-পর্ব চলাকালে সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব আমাকে বিরক্তির সুরে বলেন, আপনারা এ সমস্ত অনুষ্ঠানে ধর্মের প্রসঙ্গ না তুললেই পারেন। তার গলার স্বরে আমার প্রতি এক ধরনের উষ্মাই প্রকাশ পায়। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, তারা এটা ভুলে গেছেন যে নারী আন্দোলনের ফসল হিসেবেই এ ধরনের পদে তাদের জায়গা হয়েছে। এরকম দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে সচিব হিসেবে তিনি কীভাবে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করবেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। আরেক ধাপ এগিয়ে বলা যায়, যে দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন নিচ্ছেন, সেই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন না করে বেতন নিলে তা কি হালাল হয়? এ ব্যাপারে ধর্মই বা কী বলে? ভুলে গেলে চলবে না যে, শুধু ঘুষ খাওয়াই দুর্নীতি না, নিজের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন না করাও দুর্নীতি।

বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন পরিচালক, যিনি জেম (জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি মেইনস্ট্রিমিং) কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত, সম্প্রতি এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, শাশুড়িকে দেখে বউ-মার হাত থেকে কাঁপতে কাঁপতে পানির গ্লাস পড়ে যাবে, এটাই আমাদের সংস্কৃতি, এটাই বাংলাদেশের বিউটি। প্রশ্ন হলো, এহেন চিন্তাভাবনার অধিকারী একজন কর্মকর্তা কীভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করবেন? কী করেই বা তার পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় ভূমিকা রাখা সম্ভব? 

উল্লেখ্য, নারী ও মানবাধিকার আন্দোলনের সাথে যারা যুক্ত তাদের প্রত্যেকের অভিজ্ঞতায়ই এ ধরনের অজস্র ঘটনার উদাহরণ আছে। বাংলার লোকজ্ঞান বলে যে, সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে ভূত তাড়ানোর মন্ত্র জপে সর্ষে ছিটিয়ে কোনো লাভ হয় না, তখন সর্ষেই তাড়াতে হয়। কাজেই সরকারকে ভাবতে হবে এই সর্ষে তারা কীভাবে তাড়াবেন।

আমরা নানা সময়ে রাজনৈতিক শক্তির ভালো-মন্দ নিয়ে সমালোচনা করি, কিন্তু প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে যারা তাদের জন্য নির্ধারিত দায়িত্বের সঙ্গে এবং মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কথাবার্তা বলেন ও আচরণ করেন, তারা প্রায়ই প্রশ্নহীন থেকে যান। অথচ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন নিয়ে তারা নির্দিষ্ট দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠ থেকে প্রকৃতই জনগণের স্বার্থে কাজ করছেন কি না, ব্যক্তিগতভাবে সে কাজ করবার মতো মনমানসিকতা ধারণ করেন কি না এই প্রশ্ন জনগণের পক্ষ থেকে আমাদের রাখতেই হবে। 

তাই নারীসমাজ দীর্ঘদিন ধরে এই দাবি করে আসছে যে, প্রজাতন্ত্রের সেবক/কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুধু জেন্ডার প্রশিক্ষণ দিলেই ‘যথেষ্ট করা হয়েছে’ মনোভাব ত্যাগ করে প্রশিক্ষণের বিষয় ঠিকমতো কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ না করলে, দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করলে তার বাৎসরিক আমলনামায় এই বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে তার বেতনবৃদ্ধি, প্রমোশন ইত্যাদির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রজাতন্ত্রের ‘শাসক’ বনে যাওয়া এই বাহিনীকে জনগণের সেবক করে তুলতে না পারলে গণতন্ত্রের চর্চা বা গণতান্ত্রিক সমাজ আমরা কখনোই পাব না। আমাদের মনে রাখতে হবে শুধুমাত্র নির্বাচনই গণতন্ত্র না। গণতান্ত্রিক মনমানসিকতা, আচার-আচরণ ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে না পারলে শুধু নির্বাচন করেই গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র এবং সমাজ গড়ে তোলা যাবে না।   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *