নারী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে এখন প্রায় প্রতিদিনই আমরা যে অভিযোগে অভিযুক্ত হই তা হলো, আমরা আমাদের কাজ ঠিকমতো করছি না। যত পরিমাণে করা দরকার তত পরিমাণে করছি না। তাই ধর্ষণ, নির্যাতন এবং এই সমস্ত অপরাধের বীভৎসতার নতুন নতুন মাত্রা এত পরিমাণে বাড়ছে, যা পত্রিকার পাতায় প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়াও, সরকার তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে না, বিচারের ব্যর্থতা ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এগুলো বাড়ছে বলেও প্রায় সকলের অভিমত আমরা দেখছি। আর একটা যুক্তিও আমরা শুনি, মেয়েরা তাদের উগ্র পশ্চিমা পোশাক, চালচলন ইত্যাদির কারণে ‘ছিলা কলা’ বা ‘তেঁতুল’ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার কারণেই তারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। সুতরাং দোষ মেয়েদেরই। ছোটবেলায় তর্কবিদ্যায় লজিক এবং ফ্যালাসির সংজ্ঞা নিয়ে আমরা খুব মজা পেতাম। বর্তমানে এইসব কথাবার্তা বা যুক্তি শুনলে ভাবতে হয়, এসব কথা যুক্তি না ফ্যালাসি!
বর্তমানে মাদ্রাসায় হিজাব ও বোরকা পরা মেয়েরা যে তাদের প্রিন্সিপাল বা শিক্ষক বা ইমাম দ্বারা যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হচ্ছে, তা নারীর বিরুদ্ধে এই সমস্ত অভিযোগ যে কত অসার তা প্রমাণ করে দেয়। তাদের এই যুক্তি যে অত্যন্ত খোঁড়া তা বলাই বাহুল্য। কার্যত, এই সমস্ত যুক্তি দ্বারা তারা অপরাধীর পক্ষেই দাঁড়ান। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যে হাজারো মানুষ হাসপাতাল সয়লাব করে দিচ্ছে, মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে, তখন কিন্তু কেউ বলছে না যে আক্রান্ত ব্যক্তিরাই দায়ী। কিংবা তারা এও বলছে না যে আক্রান্তরা সারা শরীরে মশার ওষুধ মেখে মশারির ভেতরে কেন বসে থাকেন না। তাহলে ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার নারীকেই কেন খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকতে হবে?
ডেঙ্গু প্রশ্নে সবাই সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে অবহেলার কথাই বলছেন। পাশাপাশি জনগণের দায়িত্বে নিজ নিজ বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে মশার উৎপাদন ধ্বংস করার কথাও বলছেন। অর্থাৎ ডেঙ্গুর বীজ বহনকারী মশাকে মারা, তার লার্ভা ধ্বংস করাকেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ করার উপায় বলে সকলেই মনে করছেন। এজন্য আমাদের সকলের দায়িত্ব পালনে অবহেলার যে কালচার বা অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন থাকার যে কালচার, সেই কালচারকেই বদলাতে হবে। এটাই যুক্তির কথা।
সুতরাং নারীর পোশাক বা চালচলনই ধর্ষণের জন্য দায়ী এ ধরনের কুযুক্তি যারা দিতে চান, তাদের আরো মনে করিয়ে দিতে চাই যে, এই দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান এই কথা যখন আমরা বলি এবং যখন গর্ব করি এ দেশের মানুষ খুবই ধর্মপ্রাণ এবং শান্তিপ্রিয় বলে, তখন কেন এই দেশে ৫ বছরের শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়? পিতা দ্বারা কন্যা কেন ধর্ষণের শিকার হয়? কেন দুর্গাপূজাসহ অন্য ধর্মের মানুষের ধর্মীয় উৎসব পালনে পুলিশ প্রহরার দরকার হয়? যুক্তিতে কি এই সমস্ত আপ্তবাক্য ধোপে টেকে?
আমরা সকলেই জানি, কোনো দ্ব›দ্ব বা সংঘাত বা কথা কাটাকাটিতে হরহামেশাই প্রতিপক্ষের মা বা বোনকে রেপ করার কথা বলা হয়, গালি দেয়া হয়, হুমকি দেয়া হয় এবং আমাদের সমাজ এটাকে সহ্যও করে। বড়জোর ‘ছোটলোক’, ‘অশিক্ষিত’ ইত্যাদি কিছু কথা দিয়ে এটাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। আমাদের সমাজ এমনিতেই যুগ যুগ ধরে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে নারীকে অধস্তন করে রেখেছে, তার ওপর তাকে অধস্তন, খাওয়ার বা ভোগের সামগ্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, কারো মা-বোনকে রেপ করার হুমকির মাধ্যমে ক্ষমতার প্রকাশ ঘটানো হয়। এভাবেই এটা সমাজের সাবকালচার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
৮০-র দশক থেকে শুরু করে আমরা দেখেছি বাসে, ট্রেনে, বিভিন্ন চায়ের স্টলে যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ক্যাসেটে মেয়েদের ‘ছিলা কলা’ বা ‘তেঁতুল’ আখ্যা দেয়া ওয়াজের দৌরাত্ম্য। হেফাজতপন্থী আলেম ও চরমোনাইর পীরদের ওয়াজের বয়ানও তাই। তদুপরি, সারাদেশে বিভিন্ন মসজিদে, এলাকায় এলাকায় যে ওয়াজ হয় সেখানেও মূলত নারীদের অধস্তন ও ভোগের সামগ্রী হিসেবেই তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও এ আগুনে ক্রমাগত ঘি ঢেলে যাচ্ছে। এতে আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক মনোজগতে নারী অধস্তন ও ভোগ্যপণ্য— এই মতাদর্শের গ্রহণযোগ্যতাও গেঁড়ে যাচ্ছে গভীরভাবে, ব্যাপকভাবে।
আর একটা বিষয়ও এর সাথে পাশাপাশি এখন চলছে, এমনকি আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজেও। যার মোদ্দাকথা হলো, নারী যদি ঘরের বাইরে কাজ করে, তাহলে তার ‘মূল’ দায়িত্ব পালন করবে কে? অর্থাৎ, তার রিপ্রোডাক্টিভ রোল ঠিকমতো পালন করতে পারবে কি? কারণটা অবশ্যই সহজজবোধ্য। কারণ সব পুরুষই তাদের ব্যক্তিগত সেবা বিনামূল্যে পেয়ে থাকেন তাদের পরিবারের নারীদের কাছ থেকে। তাই এই ‘বিশেষ সুবিধা’র সুবিধাভোগীরা কেন এই ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইবেন?
উপরের এই চিন্তাগুলো যখন মাথার বিভিন্ন সারিতে বসে ছিল, তখনই প্রথম আলোতে দেখলাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি লেখা। লেখাটা পড়ে প্রচণ্ড হোঁচট খেলাম। প্রথমত তিনি এদেশে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একজন পুরোধ্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর চিন্তা/হাত/কলম থেকে এই ধরনের লেখা বেরিয়েছে! লেখাটি সম্পর্কে আমার অতি সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া নিম্নরূপ :
স্টিফেন হকিং-এর একটি উদ্ধৃতি এখানে ব্যবহার করছি : “দ্য ইনিমি অব নলেজ ইজ নট ইগনোরেন্স বাট দ্য ইলিউশন অব নলেজ”। মানুষের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি যুগের পর যুগের পথ পরিক্রমায় এসে বর্তমান রূপ লাভ করেছে। যার ওপর ভৌগোলিক অবস্থানভেদে আবহাওয়া, কৃষি উপকরণ, টেকনোলোজি থেকে জীবনযাপন পদ্ধতি অনেক কিছু জড়িত। এ ছাড়াও, অর্থনৈতিক অবস্থান, শহর, গ্রাম, পেশা ইত্যাদিও পোশাকের ধরন নির্ধারণ ও এর পরির্তন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে। অধ্যাপক সায়ীদ তাঁর লেখায় যা বলেছেন, সংক্ষিপ্তভাবে তা হলো নারী শরীর-সর্বস্ব। শাড়ি এবং জাপানের নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক কিমোনোর মাহাত্ম্য বোঝাতে গিয়ে আফ্রিকার নারীদের সম্পর্কে তিনি যে কথা বলেছেন, তাতে তাঁকে বর্ণবাদী হিসেবে কেউ আখ্যায়িত করলে অবাক হব না। এ ছাড়াও, তিনি টাইট জিনস, মিনিস্কার্ট যারা পরে তাদেরকে পোশাক না থাকারই শামিল অথবা ‘প্রায় বিবসনা করে রগরগে যৌনতার মৌতাত উদ্যাপন করে’— বলেছেন। তাঁর এই বক্তব্য অত্যন্ত আপত্তিজনক। তিনি শাড়ি এবং কিমোনোর গুণগান গাইতে গিয়ে যে কথা বলেছেন, তার মাধ্যমে তিনি ধর্মকে ব্যবহার করে যারা নারীকে কেবল ‘শরীর’ হিসেবে দেখে তাদের সঙ্গে একই পঙক্তিতে দাঁড়িয়ে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ১৯৯৫ সালে আমি জাপানের ওসাকা শহরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ওপর একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে যে ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল, তার অভিজ্ঞতার ওপর একটি পেপার প্রেজেন্ট করেছিলাম। সেখানে একটি কেসসটাডি ছিল এরকম :
স›দ্বীপে আমাদের এক কর্মী জলোচ্ছ¡াসে প্রায় ভেসে যাচ্ছিল। পরনের শাড়ি নিয়ে সে সাঁতার কাটতে পারছিল না। তখন সে শাড়ি খুলে ফেলে শুধু পেটিকোট-ব্লাউজ গায়ে রেখে সাঁতরে এক বাড়ির টিনের চালার ওপর আশ্রয় নিতে পেরেছিল। সেখান থেকে পরে একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে ছেলেদের একটি শার্ট গায়ে পেটিকোট পরনে সেই কর্মী সেখানে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল। সেই সেন্টারে আশ্রয় গ্রহণকারী নারী বা পুরুষ কেউই কিন্তু তার পোশাক নিয়ে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখায় নি।
এই অভিজ্ঞতা শুনে অধিবেশন শেষ হবার পর জাপানের বেশ কয়েকজন বয়স্ক নারী এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন এবং আমাকে বললেন যে, তাহলে তো তোমাদের এখন শাড়ির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে! কারণ হিসেবে তাঁরা বললেন, গত শতকের ৩০-এর দশকের মাঝামাঝি জাপানে এক প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয় এবং অনেক নারী মারা যায়। কিমোনো পরে থাকার কারণে তারা দৌড়াতে পারে নি, লাফ দিতে পারে নি এবং সেজন্য তারা নিজেদের বাঁচাতে পারে নি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জাপানে কিমোনোবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে নারীরা।
যারা শাড়ি আমাদের সংস্কৃতির অংশ, শাড়ি পরলে নারীকে কত আবেদনময়ী লাগে বলেন অথবা ধর্মের নামে যারা হিজাব হাত-মোজা, পা-মোজা পরার জন্য ওকালতি করেন, তাদের জন্য বলতে চাই, যে মেয়েরা কৃষিকাজে রত, ধান-চাল, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, মাছ, ইত্যাদি উৎপাদনে ব্যস্ত, যাদের ক্ষেত্রে অধ্যাপক সায়ীদ বর্ণিত উপায়ে শাড়ি পরার বিলাসিতা বা হিজাব, হাত-মোজা, পা-মোজা পরার বিলাসিতাও চলে না, তারা কি বাঙালি নয়? হলেও সমান বাঙালি বা মুসলিম নারী নয়! ‘কর্মব্যস্ত ঊর্ধ্বশ্বাস যুগের অকর্ষিত রুচি চাহিদা’ কি কেবল নারীর বেলায়ই? পুরুষের জন্য তাহলে তাঁর প্রেসক্রিপশনটা কী? ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি রক্ষার ঠিকাদারিত্ব কি কেবল নারীকেই গ্রহণ করতে হবে?
রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করে তাঁর শেষের কবিতার অমিতের একটা বাক্যের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটি এখানে শেষ করতে চাই : “কমল-হীরের পাথরটাকেই বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার”।