মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের একটি রক্তাক্ত অধ্যায়; ৩০ লক্ষ শহীদ, ১ কোটি উদ্বাস্তু ও ৪ লক্ষাধিক নারীর ধর্ষণের শিকার হবার ভিতর দিয়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অর্জন করেছি। বাংলার নারী-পুরুষ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল, ১৯৭২-এ তার ভিত্তিতেই রচিত হয়েছিল বাংলাদেশের সংবিধান, যে সংবিধান সুস্পষ্টভাবে ধর্ম-গোষ্ঠী-বর্ণ-লিঙ্গ-জন্মস্থান নির্বিশেষে সকল মানুষের সমানাধিকার সংরক্ষণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম স্তম্ভ নারী-পুরুষ সমানাধিকার। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্ম বা অন্য কোনোকিছুর নামে এই অধিকার খর্ব করার কারো কোনোরকম সুযোগ নেই। কারণ, রাজাকার-আলবদর ও কিছু কুলাঙ্গার বাদে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ ও আদিবাসী সম্প্রদায়, তথা জনগণের সকল অংশই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অশেষ কষ্টের বিনিময়ে এই দেশকে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর কবলমুক্ত করেছিল। ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেই এই বাংলাদেশের জন্ম।
এটা সুবিদিত যে, এই দেশের নারীসমাজের মধ্যে একজনও রাজাকার ছিল না, আলবদর ছিল না। অর্থাৎ নারীদের মধ্যে একজনও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়ায় নি। মুক্তিযুদ্ধে নারীরা অস্ত্র হাতে সম্মুখসমরে অংশ নেয়াসহ সকল ফ্রন্টেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, দুর্বিষহ শরণার্থী জীবনের ধকল সয়েছেন। সুতরাং স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে আজ কোনো প্রতিক্রয়াশীল গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, নারীসমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সকল দিক থেকে ক্রম অগ্রসরমান এই দেশকে পেছন দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলে কেউ তাদের সে সুযোগ দেবে না। বরং নারীসমাজসহ সকল জনতা মিলে তাদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করবে।
২০০৮-এ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসে বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরু করে, যে প্রক্রিয়া অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েও গেছে। দেশে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী গণহত্যাকারী, নারী ধর্ষণকারী, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজকারীরা যুদ্ধাপরাধী, যা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। নারী ও যুবসমাজসহ দেশের আপামর জনগণ ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা হবে’– এই নির্বাচনী অঙ্গীকারের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ১৪ দলীয় জোটকে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। বর্তমানে সরকার সে দায়িত্বই পালন করছে। অবিলম্বে চিহ্নিত সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করে আদালতের রায় কার্যকর করতে হবে– এই দাবি আপামর জনগণের, এই দাবি নারীসমাজসহ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এবং বিভিন্ন মতাবলম্বী সকল গণতন্ত্রকামী মানুষের।
কিন্তু আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি, চলমান বিচারপ্রক্রিয়া বানচালের লক্ষ্যে পরিচালিত যড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আজ বিভিন্ন অজুহাত তোলা হচ্ছে। সেই অজুহাতের একটি হচ্ছে, ৪২ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করা হয়েছে। একই উদ্দেশ্যে আরেক রাজনৈতিক গোষ্ঠী বলছেন যে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে নন, তবে বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে।
ইতিহাস সাক্ষী, যে লক্ষ্যে, যে চেতনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই চেতনার বিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়ে ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে দেশকে সামরিক শাসনের আওতায় নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাধীনতার পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের আগস্টে রক্তগঙ্গা বইয়ে ক্ষমতায় আসা সামরিক শাসকগোষ্ঠী স্বাধীনতাবিরোধী চিহ্নিত রাজাকার-আলবদরদের সংগঠক জামায়াতসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছে এবং ধর্মকে ঘুষ হিসেবে ব্যবহার করেছে জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা জায়েজ করার জন্য। এর মধ্য দিয়েই দেশকে বা দেশের রাজনীতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে নিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে। পাশাপাশি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে বাংলার মাটিতে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছে এই সামরিক শাসকরাই। ওই সময়ই কার্যত জাতিকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়েছে এবং এর দায়ভার জিয়া ও এরশাদের ওপরই বর্তায়। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীর বিচারের মাধ্যমে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করার যে বক্তব্য আসছে, সেটি অবান্তর।
নারীসমাজ, আদিবাসী সম্প্রদায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং ছাত্রসমাজের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্র জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, জাতীয় শিক্ষানীতিসহ বিভিন্ন নীতি রাষ্ট্রের কাছ থেকে আদায় করেছে। এসব নীতি বাস্তবায়ন এবং নীতি ও আইনসমূহকে আরো যুগোপযোগী করে তোলার জন্য যখন দেশের মানুষ সরকার ও রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে কাজ করছে, তখন চিহ্নিত গোষ্ঠীটি ধর্মকে ব্যবহার করে বারবার এর বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে এবং দেশে আবারো পাকিস্তানের আদলে তালেবানি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতিকে দৃঢ়মূল করতে বিভিন্ন সহিংস পন্থা অবলম্বন করছে। ৭৫-এর পর থেকেই এরা মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ ও দেশের ভেতরের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মুনাফার অর্থে বিপুল সংখ্যক মসজিদ ও মাদ্রাসা স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে শক্তি সংহত করে চলেছে। প্রচুর কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়ে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহারের জন্য তৈরি করেছে। একই উৎসের সহায়তায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল পরিচালনা করে চলেছে এবং ধর্মীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এসব কার্যক্রম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী তালেবানি ধারাকে আরো বেগবান করেছে। এই গোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ক্রমাগত সহিংস প্রসারমান প্রচেষ্টাই বাংলাদেশ থেকে এই পাকিস্তানমার্কা রাজনীতির অবসান ও যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিকে আরো অপরিহার্য করে তুলে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক শাসন অবসানের পরপরই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালে ব্যাপক ভিত্তিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এখন ওই দাবির বাস্তবায়ন চলছে।
বর্তমানে অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমরা একটি বিষয় লক্ষ করছি। আমাদের প্রধান বিরোধী দল, যারা জামায়াতকে আগেই তাদের সরকারের অংশ করেছে, এখন হেফাজতে ইসলামকে সমর্থন দিচ্ছে। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ অবলম্বন করে বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ হেফাজতকে সমর্থন দেবার জন্য জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্যও রাখছেন। আমরা ৬ এপ্রিলে ঘোষিত হেফাজতের ১৩ দফা দেখেছি, যে দাবি কোনো গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষেই মানা সম্ভব নয়। এর পর ৫ মে তাঁরা যে বক্তব্য রেখেছেন, তার প্রায় পুরোটাই মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক চেতনাবিরোধী, সংবিধানবিরোধী। এই গোষ্ঠী নারীর সমানাধিকার দূরে থাকুক নারীর প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা রাখে না, তা হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর মোহাম্মদ ওয়াক্কাসের বক্তব্যের একটা অংশ তুলে দিলেই পরিষ্কার হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সম্বোধন করে তিনি বলেন, “একের পর এক এই বাংলাদেশকে জারজ সন্তানের দেশে পরিণত করতে চান আপনি। তাই, অন্তত ২৫টি কোরানের আয়াতবিরোধী সিডও ছনদে স্বাক্ষর করেছেন। নারীনীতি এই দেশে প্রবর্তন করেছেন। পাস করেছেন, আইনে পরিণত করেছেন। আপনি কি জানেন না? এর পরিতাপে বাংলাদেশ হবে জারজের লীলাক্ষেত্র। ইউরোপ-আমেরিকার দিকে তাকান আপনার ছেলেরা আত্মীয়-স্বজনরা সেখানে থাকেন। আপনি ভালো করেই জানেন। আমার থেকে বেশি জানেন, কম জানেন না। সেই দেশের পরিসংখ্যানে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ সন্তান জারজ সন্তান। আপনি বাংলাদেশে সিডও ছনদ আইনকে, সিডওকে আইনে পরিণত করে, কোরানবিরোধী নারীনীতি বাস্তবায়ন/পাস করে বাংলাদেশকে জারজ সন্তানের দেশে পরিণত করতে চান। আর এখানে ধোঁয়া তুলেন নারীর অধিকার, নারীর অধিকার। নারীদেরকে বেশ্যা বানাইয়া নারীর অধিকার রক্ষা করা যায় না। নারীর ইজ্জত বেশ্যা বানাইয়া হয় না। নারীর ইজ্জত হয় কুলবধূ, গৃহবধূ বানায়ে। সতীত্ব রক্ষার বাধ্যবাধকতায় নারীর ইজ্জত হয়। সতীত্ব হরণের মাধ্যমে নারীর ইজ্জত রক্ষা হয় না।”
গণতান্ত্রিক মনমানসিকতার কোনো মানুষ, কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ বা রাষ্ট্র এই ধরনের ঘৃণ্য বক্তব্য (hate speech) সমর্থন করতে পারে না। এই যাদের বক্তব্য, এই যাদের মনমানসিকতা, সেই মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা শক্তিকে যারা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই দেশের রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ করতে চায়, তাদের মানসিকতাও কারো কাছে আর অস্পষ্ট থাকে না। তাদের এ ধরনের বক্তব্য প্রচারের জন্য আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী অবিলম্বে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।
হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াত-শিবিরসহ ধর্মকে ব্যবহার করে যারা রাজনীতি করছেন, যারা ধর্মের নামে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলছেন এবং দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করছেন, তাদেরকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীসহ এদেশের তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবীকে দেখছি শোরগোল তুলতে। এমনকি এদের কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে পৃথিবীব্যাপী মিথ্যা অপপ্রচারের একটা গোয়েবলসীয় মেশিনও চালু করে নিয়েছেন। তাদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, যারা মানুষের সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, নারী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যারা নিরন্তর ঘৃণ্য অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, যারা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে নিরন্তর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, বাসে-সিএনজিতে আগুন লাগিয়ে মানুষ হত্যা করছে এবং শান্তি-শৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটিয়ে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে চলেছে, তাদের পক্ষ অবলম্বন করা কি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যৌক্তিক? নারী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এরা প্রতিনিয়ত যে ঘৃণ্য কার্যক্রম (hate campaign) চালিয়ে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো অবস্থায়ই তাদের এই কার্যকলাপ সমর্থনযোগ্য নয়। এজন্য তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তাদের সমর্থকদেরও বিচারের আওতায় আসতে হয়।
লক্ষণীয় যে, এই অপশক্তির অধিকারের পক্ষের সোচ্চার বুদ্ধিজীবীরা যুদ্ধাপরাধীর বিচার ছাড়া অন্য কোথাও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রসঙ্গ তুলছেন না। তারা কখনো এটা বলেন না যে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ধর্মের নামে অন্যের অধিকার, অন্যের মানবাধিকারের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার কারো নেই। আন্তর্জাতিক নিয়মে ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। কিন্তু মৌলবাদী গোষ্ঠীটি অন্যের অধিকারের ওপর ন্যূনতম শ্রদ্ধা না-দেখিয়ে তাদের নিজেদের মত অন্য সবার ওপরে চাপিয়ে দেবার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
এমনকি ৫ মে হেফাজতে ইসলাম যে ৬ শতাধিক কোরান পুড়িয়েছে, তা নিয়েও এই সমালোচক শ্রেণিকে কোনো কথা বলতে দেখি নি। এই বর্বরতা যে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সমর্থনযোগ্য নয়, সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো উদ্বেগ দেখা যায় নি। ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করেন ও করা সমর্থন করেন এমন কোনো সংগঠনকেও এ ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ করতে দেখি নি। কিংবা বিসমিল্লাহ গ্রুপ যখন ব্যবসা করতে নেমে প্রচুর লোককে ঠকায়, তখন যে ‘বিসমিল্লাহ’র অপমান হয়, এটা নিয়েও এই গোষ্ঠীর কাউকে কোনো উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় নি। অথচ আমেরিকায় যখন একজন কোরান পোড়াবার হুমকি দেয়, তখন আমরা বাংলাদেশের ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ এবং মৌলবি সম্প্রদায়কে হৈচৈ করে মাঠে নামতে দেখেছি। কাজেই এরা যে ধর্মের ব্যবহার করে ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে, এটা আজ সকলের কাছেই স্পষ্ট।
আমরা স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কথা বললে চলবে না। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে কেউ রাজনীতি করতে চাইলে, রাজনৈতিক দল গঠন করতে চাইলে, সামাজিক সংগঠন পরিচালনা করতে চাইলে, আইনের আশ্রয় পেতে চাইলে, শাসন ক্ষমতায় যেতে চাইলে তাদের আচার-ব্যবহার-কার্যকলাপ-বক্তব্যও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যেতে পারবে না এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমরা বলতে চাই, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নারীবিরোধী বক্তব্য প্রদানকারী ব্যক্তি ও দলের বিরুদ্ধে আপনাদের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উত্তরাধিকার ও পারিবারিক আইনসহ সকল জায়গায় নারী-পুরুষ সমান অধিকার দিয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নির্ণিত একটি আন্তর্জাতিক মানের নারীনীতি বাংলাদেশের জন্য প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত সিডও সনদের ২টি ধারার ওপর সংরক্ষণ বহাল রেখেছে, আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী এটা গ্রহণযোগ্য নয়। অতি সত্বর সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
আমাদের দেশে যে ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে সেটা মোটেই আন্তর্জাতিক মানের নয়। তথাকথিত ধর্মশিক্ষার নামে গরিবদের জন্য বর্তমান মানের মাদ্রাসা শিক্ষা চালু রাখা চলবে না। শিক্ষানীতি অনুযায়ী মাদ্রাসা শিক্ষায় বাংলা, অংক, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি পড়াবার ব্যবস্থা করে এই শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। আরবিকে এখানে একটি ভাষা হিসেবে পড়বার ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থ না-শিখিয়ে শুধু তোতাপাখির মতো মুখস্থ করালে চলবে না। এরকম ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা অর্থ বুঝে সেসব পড়তে পারে। এর ফলে ভুল বুঝিয়ে তাদের সহজে বিপথগামী করা যাবে না। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষার সকল পর্যায়ে সংস্কার সম্পন্ন করে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এছাড়া, মাদ্রাসা ও মসজিদ যার টাকায়ই প্রতিষ্ঠিত হোক, এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক মানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার প্রদত্ত বিনা পয়সার পানি-বিদ্যুৎসহ দেশ-বিদেশের কোন উৎস থেকে বছরে কত টাকা আয় হয় এবং কোন খাতে কত ব্যয় হয়, তার পরিষ্কার হিসেব থাকতে হবে এবং প্রতিবছর তার অডিট হতে হবে। একইভাবে নারী ও দরিদ্র জনগণের জন্য দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেও আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে, যাতে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি বছর ১৫ হাজার মাকে জীবন দিতে না হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পানীয় জল সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অবদান গুরুত্বপূর্ণ, যা জিডিপির ৪৬ শতাংশ। উন্নয়নের পথের অন্তরায়গুলো দূর করে একটি সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তারা প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। কাজেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। গৃহে ও কর্মস্থলে সর্বক্ষেত্রে তাদের কর্মপরিবেশ আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। প্রতিটি রান্নাঘরে গ্যাস ও পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করে তাদের গার্হস্থ্য কর্মভার লাঘবে উদ্যোগ নিতে হবে।
নারীসমাজ এদেশের শ্রমিক সমাজের সুবিধাদির ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রয়োগ চায়। আমরা জানি, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী শ্রেণি আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে অহরহ জিনিসপত্রের দাম বাড়ান, দেশের মানুষকে যেসব জিনিস কিনে খেতে হয়। কিন্তু সে অনুযায়ী তারা শ্রমিকদের সুযোগসুবিধা দেন না। আমরা দাবি করছি, শ্রমিকদেরও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বেতন দিতে হবে। কর্মস্থলে তাদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে। মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে হবে। আইএলও কনভেশন অনুযায়ী ৮ ঘণ্টার বেশি শ্রমিকদের কাজে বাধ্য করা যাবে না।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও নারীসমাজের পক্ষ থেকে আমরা জোর দাবি জানাতে চাই। যারা ধর্মকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করে রগকাটার রাজনীতি করে, ধর্মকে ব্যবসায়ের হাতিয়ার বানায়, ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষের ওপরে নির্যাতন-নিষ্পেষণ-জুলুম চালায়, রাষ্ট্রে অস্থিরতা তৈরি করে, তাদের পেছনে আপনারা অর্থ ঢালবেন না। মডারেট মুসলিম বানিয়ে তুলবার জন্য বিভিন্ন সময় তাদের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে আপনারা উন্নয়নবিরোধী একটা অপশক্তিকেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠবার সুযোগ করে দিচ্ছেন। মডারেট মুসলিম বানাবার জন্য চেষ্টা-চরিত্র করে আপনারা একের পর এক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, সংবিধানবিরোধী, নারীর সমান অধিকারবিরোধী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারবিরোধী শক্তিকে মদদ দিয়ে যেতে থাকেন, কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সমান নাগরিকত্বের শিক্ষা তাদের দেন না। বরং পিঠে হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিয়ে থাকেন, যাতে তারা আপনাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা না বলে। এমতাবস্থায়, আপনাদেরও কোনো অধিকার থাকে না বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মানবাধিকারের ব্যবস্থা দাবি করার।
আমাদের দাবি, নারীসমাজ ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীসহ শ্রমিক, কৃষক সকলের ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সকলের জন্যই এক নিয়ম প্রযোজ্য হতে হবে। যারা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য শুধু আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কথা বলেন, সেসব বুদ্ধিজীবী ও ব্যক্তিবর্গের প্রতিও আমরা নারীসমাজের পক্ষ থেকে এই বক্তব্য রাখতে চাই যে, গণতন্ত্র শুধু কিছু পুরুষের জন্য নয়। গণতান্ত্রিকভাবে সব কাজে সবার সমান অধিকার আছে। কাজেই কারো বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপপ্রচার চালাবার অধিকার কারো থাকতে পারে না। এতে সমর্থন দেয়া মানে হলো আপনারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। সেক্ষেত্রে এই দেশের নারীসমাজ আপনাদের আর একটুও জায়গা দেবে না, বরং আপনাদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াবে। কারণ আমরা চাই নারী-পুরুষ সমতাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ, রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ।
সরকারি দল হোক বা বিরোধী দল হোক বা কোনো সামাজিক সংগঠন হোক, ৩০ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে প্রাপ্ত এই বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হলে ন্যূনতম শর্ত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এর নিচে নেমে কোনো আলাপ-আলোচনা (bargain) বা সমঝোতার সুযোগ কারো নেই।