সম্প্রতি ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বিরোধী যে তুমুল আন্দোলন চলছে তাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সকল আলোচনা ও কথাবার্তায় কয়েকটি বিষয় ঘুরেফিরে সর্বদাই প্রাধান্য পাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’, ‘পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়’ অন্যতম প্রধান দুই বিষয়। এ ছাড়াও ধর্ষণের মতো জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধকে ‘মা-বোনের সম্ভ্রম বা ইজ্জতহানি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আরো আছে ধর্ষণকে ‘পাশবিক নির্যাতন’ হিসেবে চিহ্নিত করা। এ প্রপঞ্চগুলো নিয়ে মোটা দাগে কিছু ভাবনা বা কারণ খোঁজার চেষ্টায় এই সংক্ষিপ্ত লেখা।

প্রথমত, আমার জানামতে পশুপাখির যৌন মিলনে ধর্ষণ-এর মতো কোনো চর্চা নেই। প্রাণিজগৎ ও তার প্রজনন নিয়ে যারা পড়াশোনা করেছেন বা কাজ করেন তাদের কয়েকজনের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনায় এ মতের সমর্থনও পেয়েছি। তাই ‘পাশবিক’ নির্যাতন কথাটার যর্থাথতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এবং যুক্তি অনুযায়ী তা ফেলে দেওয়ার নয়। 

‘কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা’, ‘মেয়েকে পাত্রস্ত’ করা কিংবা ছেলের বিয়ে করতে যাওয়ার সময় মাকে প্রণাম করে বলা যে, ‘মা, আমি তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি’— এগুলোর সবই নারী বা কন্যাসন্তান সম্পর্কে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে তুলে ধরে। যে সমাজ পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক— সে সমাজের পরিবারপ্রধান পুরুষ পিতাটিরই যদি কন্যাসন্তানকে ‘দায়’ হিসেবে দেখতে হয় এবং তার জন্য সমাজে ‘দায়গ্রস্ত’ হয়ে থাকতে হয়, সে সমাজের এই অবস্থাই সাক্ষ্য দেয় একজন কন্যাকে, নারীকে কী হিসেবে দেখা হয়। আর পরিবারের ভিতরেই তারা বাবা, ভাই, চাচা, মামা, শ^শুরসহ অন্য নিকটাত্মীয় দ্বারা ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হন। পাশাপাশি তাদের রাস্তাঘাট, যানবাহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রসহ সব জায়গায়ই যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। সুতরাং পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ-এর অবক্ষয় কথাটির যৌক্তিকতা কতটুকু, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে প্রশ্নটির সুরাহা হওয়া দরকার। কারণ এসব আপ্তবাক্যের আড়ালে মূল সমস্যাকে ধামাচাপা দেওয়া হয়। কন্যাসন্তানকে দায় হিসেবে দেখার মূল কারণ যে উত্তরাধিকারে সমান অধিকার না থাকা, এ সত্যটিকে কখনোই সামনে আনা হয় না। 

ছোটবেলায় চাচার সঙ্গে বিকেলবেলায় বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া আমার একটি আনন্দময় শখ ছিল। একদিন চাচা একটু বেশি পরিপাটি হয়ে বের হওয়ার সময় আমি সঙ্গী হতে চাইলাম। কিন্তু উত্তর পেলাম, তিনি তার এক ‘দোস্ত’-এর ছেলের জন্য পাত্রী/কন্যা পছন্দ করতে যাচ্ছেন এবং সেখানে বয়স্ক অভিভাবকরাই শুধু যাবেন। আমার খুব মন খারাপ হলো। তখন চাচাকে বললাম তারা যে দোকানে ‘কন্যা’ পছন্দ করতে যাচ্ছেন সেই দোকানটির নাম নিয়ে আসতে। সুপ্ত ইচ্ছা ছিল পরদিন স্কুল থেকে আসার পথে সে দোকানে গিয়ে ‘কন্যা’ বা পাত্রী দেখে আসব। আমার এই কথা শুনে উপস্থিত সকলেই আমার ‘গাধা’ত্ব দেখে প্রচুর হেসেছিলেন আর আমি ভীষণ অপমানিত বোধ করেছিলাম। এখন মনে হয় গাধার মতো আমার ওই কথাটিই একটি কঠোর সত্য সমাজে নারীকে পণ্য হিসেবে দেখা হয়। যেমন, মেয়ের গায়ের রং, চুল, নাক, মুখ-এর গড়ন ইত্যাদি যত সুন্দর হবে, বিয়ের বাজারে তার মূল্য ততই বেশি। এ ছাড়াও তাকে দেখা হয় ভোগের বস্ত, সন্তান উৎপাদনের কারখানা, পরিবারের বিভিন্ন কাজ ও সেবাদান এবং সবার জন্য বিনাবেতনের জোগানদাতা হিসেবে। 

আমাদের দেশের প্রগতিশীল অনেকেই বলেন, বাজার অর্থনীতি নারীকে পণ্য হিসেবে মিডিয়ায়, সমাজে তুলে ধরছে। কথাটা ঠিক, কিন্ত অর্ধসত্য। পরিবার, সমাজ নারীকে যেভাবে দেখে বাজার সেই মনমানসিকতাকেই পুঁজি করে মুনাফা লোটে। ছোটবেলা থেকেই আমরা বিভিন্ন ওয়াজ ও খুতবায় শুনে আসছি যে, পুণ্য করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে এবং সেখানে বিভিন্ন সুস্বাদু ফল, পানীয় ইত্যাদির সাথে ৭০টি হুর-পরিও পাওয়া যাবে। আর সর্বশেষ এখন তো দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ক্যাসেট ও হেফাজতের বদৌলতে নারী ছিলাকলা বা তেঁতুল হিসেবে অনেকেরই মানসপটে। এ ছাড়াও, ‘স্বামীর পায়ের তলায় বেহেশত’— এই ওয়াজ বা খুতবা হরহামেশাই দেওয়া হয়। এসব যারা শোনেন তাদের মধ্যে শুধু শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিতরাই নন, অনেক উচ্চশিক্ষিত ধনী লোকও থাকেন। থাকেন অনেক রাজনীতিবিদও, যাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন। তারাও এর প্রতিবাদ করেন না, ভাবেন না এ অবস্থায় তাদের মা, বোন বা মেয়ে ৭০ জনের পর ১ জন হবেন। 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের অনেকেই ভাবেন না এই সমস্ত বক্তব্য সংবিধানবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। যারা ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’-এর রাজনীতি করছেন, তারাও এর বিরুদ্ধে কিছু বলছেন না। মূল বিষয় হচ্ছে আমরা যুক্তি-বুদ্ধি ইত্যাদি ব্যবহার করি না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও এরূপ, যা আমাদের যুক্তি-বুদ্ধি খাটাতে বা প্রশ্ন করতে শেখায় না। তা না হলে কিছুদিন আগেও ফতোয়া দেওয়া হতো ছবি তোলা হারাম, কোরান-হাদিসে নিষেধ আছে। এ সম্পর্কিত আরজ আলী মাতুব্বর-এর জীবনের ঘটনাটি আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই স্পষ্ট হয় যে, যখন কোরান-হাদিস নাজেল হয়েছে, তখন ক্যামেরা বা ছবি তোলার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই কোরান-হাদিসে তার উল্লেখ থাকবার প্রশ্ন আসে না। 

মাত্র ৪/৫ দিন আগে এক টিভিতে নিয়মিত প্রচারিত এক ধর্মবিষয়ক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হুজুরকে একজন প্রশ্ন করলেন, যে রুমে টিভি আছে সে রুমে নামাজ হবে কি না এবং হাদিসে এ বিষয়ে কী নির্দেশ দেওয়া আছে? প্রশ্নকর্তা নিশ্চিয়ই অশিক্ষিত নন, তবু তার মাথায় আসে না যে ইসলাম যখন প্রবর্তিত হয় ও কোরান-হাদিস যখন লিপিবদ্ধ হয়, তখন টিভি ছিল না; তাহলে এ বিষয়ে কোরান-হাদিসে কীভাবে নির্দেশ থাকবে? 

সবশেষে এটুকুই বলতে চাই, আমাদের অসচেতনতা শুধু বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষার মাধ্যমেই দূরীভূত হবে তা নয়, যেমন এনজিও সেক্টর, রাষ্ট্রের প্রশাসন, আইন বিভাগ, পুলিশ বাহিনী, বিচার বিভাগ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ যে যেখানেই কর্মরত আছেন, তারা সবাই তুলনামূলকভাবে উচ্চশিক্ষিত। তারপরও দেখা যাচ্ছে যে, সব সেক্টরে নিয়োজিতদেরই জেন্ডার এবং মানবাধিকার বিষয়ে সংবেদনশীল করার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হচ্ছে। কারণ ‘মূল্যবোধ’, ‘পরিবারের সম্মান’, ‘নারীর ইজ্জত’— এ বিষয়সমূহকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে না দিয়ে সমস্যার মূলসমূহকে বিশ্লেষণ করেই আমরা কী ধরনের ‘মূল্যবোধ’ চাই, কী ধরনের ‘গণতন্ত্র’ চাই, কী ধরনের ‘শিক্ষা’ চাই— সেগুলো স্পষ্ট করা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *