বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস আমাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে যে অভ্যাস চালু করতে পারে নাই, করোনা তা পেরেছে। মানুষ এখন হাত ধোয়ার ব্যাপারে অনেক সচেতন হয়েছে। তা ছাড়া, ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ের যে হাইজিন, সামাজিক যে শিষ্টাচার (হাঁচি, কাশি, নাক ঝাড়া, থুথু ফেলা) মানুষ তা শিখছে; বাসার সুইচবোর্ড, দরজার হ্যান্ডেল পরিষ্কার করা শিখছে; সামাজিক ও ব্যক্তিগত দূরত্ব বজায় রাখা যে দরকার সেটা শিখছে। বাংলাদেশে আমরা সাধারণত এরকমটা দেখি না। এখানে একজনের ঘাড়ের ওপরে অন্যজনের নিঃশ্বাস পড়ে। সভা-সমিতিতে বসার ক্ষেত্রে যে ন্যূনতম দূরত্বটা রক্ষা করতে হয় সে শিক্ষা আমাদের ছিল না প্রায়, যা আমরা এখন পাচ্ছি। এই শিক্ষাকে অভ্যাসে পরিণত করে যদি আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম চালিয়ে যেতে পারি, তাহলে আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন পরিলক্ষিত হবে।
একটা বড়ো শিক্ষা সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া অন্য কোথাও দেখি না যে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে নারীসমাজ, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থাকে। এটাকেই আমরা নারীর জন্য উপযুক্ত স্থান ভাবি। এখন করোনা বিস্তার রোধ করার জন্য যখন পুরুষদেরও ঘরে থাকতে হচ্ছে, তখন এটাকে তাদের বন্দি জীবন হিসেবে ভাবা হচ্ছে। আমরা দেখছি তারা দুয়েকদিন যেতে না যেতেই হাঁপিয়ে উঠছেন ও ভাবছেন এই অবস্থা আর কতদিন! ঘরে থাকতে হওয়ার এই অবস্থাটি কি তাদের এই উপলব্ধিটুকু দেবে যে নারীর চার দেয়ালে বন্দি জীবন কতটা দুর্বিষহ? নারীর এই বন্দি জীবন সম্পর্কে কি তারা এখন নতুন করে ভাবছেন বা ভাববেন?
ঘরে আটকে থাকায় তাদের হাতে কোনো কাজ নেই বলে যখন তারা হাহুতাশ করছেন, তখন তারা কেন ঘরের কাজ, যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, কাপড় কাচা, ধোয়া-মোছা, রান্নাবান্নার কাজগুলো শিখছেন না ও করছেন না? এ সময়ে নারীর ঘরের কাজের চাপ সাধারণ সময়ের চাইতে আরো বেড়েছে। ঘরের কাজে সমানভাবে তারাও অংশ নিলে তিন দিক থেকে লাভবান হওয়া যেত ১. পুরুষদের ঘরে থাকার সময়ের সদ্ব্যবহার হতো, ২. তারা ঘরের কাজকে নিজেদের কাজ মনে করতে পারত এবং ৩. নারীদের কাজের ভার কিছুটা কমত। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি আমরা যদি ঘরের কাজ ভাগাভাগি করে করে যেতে পারি, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জগতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা যে খবর পাচ্ছি— সারা পৃথিবীতেই এ সময়ে নারীর ওপর কাজের চাপ বাড়ার পাশাপাশি নির্যাতনও বাড়ছে। বাচ্চাদের দেখাশোনা করা, পড়াশোনায় সহযোগিতা করার জন্য যে ব্যবস্থাপনা সেটা শুধু নারীদের ওপরে না চাপিয়ে এ দায়িত্বও পুরুষরা নিতে পারে। নির্যাতনের যে কথাগুলো মিডিয়ায় এসেছে ও আসছে সে ব্যাপারেও আমাদের পুরুষরা সচেতন হতে পারে।
ঘরে হাঁপিয়ে ওঠার অজুহাতে অনেক সময় পুরুষরা ঘরে থাকার নিয়ম উপেক্ষা করে ঘরের বাইরে সোশ্যালাইজেশনে যাচ্ছেন এবং ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে ফিরে এসে ঘরের নারী ও শিশুদের সংক্রমিত করছেন। যেহেতু এ সময়ে নারীরা ঘরের বাইরে যাচ্ছেন না, কাজেই এই সংক্রমণের জন্য তারা কোনোভাবেই দায়ী নয়, অথচ তাদের ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে।
করোনাকালে আরো যে শিক্ষাগুলো আমাদের সামনে এসেছে তা হলো, এখন আমরা দেখছি সারা বিশ্বেই স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ প্রয়োজনের তুলনায় কত কম! এটা উন্নত-উন্নয়নশীল-অনুন্নত যে দেশের দিকেই তাকাই না কেন সর্বত্রই একই চিত্র। সবার চোখের সামনেই এটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে এবং একটা জোর তাগিদ এসেছে যে জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্র এবং সমাজকে কোথায় কোথায় অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। এই শিক্ষাটাকে দুর্যোগ উত্তরণের পরেও আমাদের ধরে রাখতে হবে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে চলছে, সেটা আমূল পালটে শিক্ষার উন্নত মান নিশ্চিত করা এবং কোন কোন খাতে কোন কোন বিষয়ে শিক্ষা নিতে হবে সেটা এখন স্পষ্ট হয়ে এসেছে। সাধারণ স্বাস্থ্য এবং বিজ্ঞান, বিশেষ করে জীববিজ্ঞান, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান, যেগুলো জীবনযাপন এবং বৃত্তিমূলক ক্ষেত্রে দক্ষতা তৈরি করে, সে শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা দরকার। জনগণের সেবা দেবার জন্য স্বাস্থ্যখাতে ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ সবার দক্ষতাবৃদ্ধিসহ সংখ্যাবৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তাও এখন সামনে এসেছে। তা ছাড়া, প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে জনগণেরও সচেতনতা ও দক্ষতাবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম থাকা দরকার।
আরেকটি বিষয়েও বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে যে সমস্যা এখন হচ্ছে তা সমাধান করার জন্য অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদের সহ সকল শ্রমিকের জন্যই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে সরাসরি তাদের বেতন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায়। তাতে শুধু দুর্যোগের সময় না, স্বাভাবিক সময়েও বেতন-ভাতা নিয়ে যেসব অভিযোগ আসে, যেমন নিয়মিত বেতন না হওয়া এবং বেতন কাটা, এ বিষয়গুলো একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে।
যে কোনো সংকটজনক অবস্থা মানুষকে এমন কিছু অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি দেয়, যা বিভিন্নভাবে মানুষের কাজে লাগে। আমাদের জীবনযাপনের মান উন্নত করে সকল মানুষের মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ বিষয়গুলো নিয়মিতকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে পরবর্তী সময়েও এই অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা আমাদের কাজে দেয়।