আমি যখন বকশীবাজারস্থ ঢাকা গভর্নমেন্ট গার্লস ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে বদরুন্নেছা গার্লস কলেজ)-এ পড়ি, ছাত্র ইউনিয়ন করার সুবাদে তখন থেকেই আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে হতো। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তো বটেই, এরও আগে যে আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছে, যেমন আওয়ামী লীগের ৬ দফা বা ছাত্রদের ১১ দফা— সবগুলোতেই আমি অংশগ্রহণ করেছি মিছিলের অগ্রভাগে স্লোগানে-স্লোগানে মিছিল জমিয়ে তোলার কাজে। কাজেই ১৯৬৯-এ যখন আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন বিশ^বিদ্যালয়ের আনাচকানাচ, মধুর ক্যান্টিন, ছাত্রীদের কমনরুম, বটতলা, রোকেয়া হল আমার কাছে আর নতুন ছিল না, বরং ছিল অতি চেনা ও পুরাতন।
১৯৭০-এর নির্বাচন এবং ’৭১-এর জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও উত্তাল মার্চে আমাদের রাতের থাকার জায়গা রোকেয়া হল হলেও সারাদিনই পায়ে হেঁটে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে পুরান ঢাকার আনাচকানাচ, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, বায়তুল মোকাররমসহ সব জায়গা আমরা চষে বেড়াতাম। স্ট্রিট কর্নার মিটিং, ছোট ছোট মিছিল থেকে বড় মিছিল কোনোটিই বাদ যায় নি। তখন আমাকে সবাই স্লোগান মাস্টার বলত। ’৭১-এর ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর আমাদের বিশ^বিদ্যালয় হয়ে দাঁড়ায় ঢাকা শহরের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের কেন্দ্র। তখন শহরের সর্বত্রই যেন খোলা হয়ে যায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ থেকে গেরিলাযুদ্ধের কলাকৌশল শিক্ষার অফিস।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন আবার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হলো তখন আমাদের স্লোগান হলো ‘এবারের সংগ্রাম দেশ গড়ার সংগ্রাম’। ১৯৭২ সালে মে মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ডাকসু ও বিভিন্ন হল সংসদের নির্বাচন হলো। সেই নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে আমি যখন রোকেয়া হল সংসদের সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হই, তখন আমি মাত্র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আমার ভোটারদের সিংহভাগই ছিল আমার সিনিয়ার। কারণ তখন শামছুন নাহার হল চালু হয়ে যাওয়ায় প্রথম বর্ষের সব ছাত্রীই শামছুন নাহার হলের অ্যাটাচড অথবা রেসিডেন্ট হিসেবে ভর্তি হতো।
মনে পড়ে, তখন যারা ঢাকার বাইরে থেকে বিশ^বিদ্যালয়ে পড়তে আসত, আমরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সহযোগিতা করতাম, হলে ওদের সঙ্গে ডাবলিং-টিপলিং করে থাকতাম। আমরা এটাকে বলতাম ‘মুরগি ধরা’! এদের অনেকের সঙ্গে পরে সম্পর্ক তৈরি হতো। প্রথম কিছুদিন মিটিংয়ে যেত, যদিও পরে অনেকই ঝরে পড়ত। তবে ২০/২৫ জনের মধ্যে মোটামুটি স্থায়ীভাবে টিকে যেত ৪/৫ জন, যারা সংগঠনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সক্রিয় হতো, মিটিং-মিছিলে অংশ নিত। যারা সংগঠনে সক্রিয় হতো না তারা অন্তত ভোটার হিসেবে থেকে যেত, মাসে মাসে চাঁদা দিত। এক-দুই টাকা থেকে চার আনা, আট আনা। অর্থাৎ, মুরগি ধরার ব্যাপারটা লাভজনকই ছিল।
রাজনীতিতে সক্রিয় ও হল সংসদে নির্বাচিত হওয়ায় আমার নিয়মিত ক্লাস করা হতো না। একবার টিউটোরিয়াল টিচারের কাছে উপস্থিতির সনদ নিতে গেলে স্যার বললেন, তোমাকে সব সময় মিছিল-মিটিংয়ে দেখি, কিন্তু তুমি যে আমার ছাত্রী তা তো জানতাম না! যাই হোক, তবু আমাদের কখনো নকল করতে হয় নি, পরীক্ষা পিছানোর আন্দোলনও করতে হয় নি। আমরা ক্লাস না করার ক্ষতিটা অন্যভাবে পুষিয়ে নিতাম। পরীক্ষার আগের একমাস আমরা রাজনীতি না করা বন্ধুদের সাথে একত্রে গ্রুপে পড়তাম। এখানে দিলরুবা, জোছনা, পারভীন ওদের কথা বলা যায়। ওদের দায়িত্ব ছিল টিচাররা কী পড়াতেন তার খোঁজখবর রাখা ও মূল বই জোগাড় করা। মূল বই পড়তাম বলে আমার পরীক্ষায় কখনোই খারাপ করতে হয় নি, বরং সন্তোষজনক নম্বরই পেতাম।
সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের মূল প্রতিদ্ব›দ্বী সংগঠন ছিল ছাত্রলীগ। আমাদের সঙ্গে বিরোধ বলতে ছিল মূলত রাজনৈতিক। আমরা সমাজতন্ত্রের এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের কথা বলে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার কথা বলতাম। সেই জন্য পাকিস্তানি ২২ পরিবারের পরিবর্তে যাতে বাংলাদেশে পুঁজিবাদী পরিবার গড়ে না ওঠে, সে সম্পর্কে বলতাম। তখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা খুব বেশি ছিল। কিন্তু ছাত্রলীগ জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের কথাই বেশি বলত এবং আমাদেরকে মস্কোর এজেন্ট আখ্যা দিত। মস্কোয় বৃষ্টি হলে আমরা ঢাকায় ছাতা ধরি, এ বক্তব্যও তাদের ছিল। অন্যদিকে আমরা ওদের বলতাম, ওয়াশিংটনে বৃষ্টি হলে তোমরা ঢাকায় ছাতা ধরো। রাজনৈতিক স্লোগানের পাশাপাশি নানারকম মজার মজার স্লোগানও আসত তখন। আবদুল কুদ্দুস মাখন যেবার ভিপি প্রার্থী হলেন, তখন ছাত্রলীগের একটা স্লোগান ছিল এরকম যে, ‘রুটি যদি খেতে চাও, মাখনকে ভোট দাও’।
তখনকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছিল অন্যরকম। বিভিন্ন স্লোগান, মিছিল-মিটিং নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আমাদের মধ্যে নানারকম তর্কবিতর্ক হতো, ধাক্কাধাক্কি-ঠেলাঠেলিও হতো। কিন্তু এসব নিয়ে এখনকার মতো বড়ো ধরনের কোনো সংঘাত তৈরি হয় নি। আমরা অনেক সময় একসাথে বসে আড্ডা দিতাম, চা-সিঙ্গারা খেতাম, আবার মিটিং কিংবা পোস্টারের জায়গা দখল নিয়ে বিতর্কেও জড়িয়ে যেতাম। কিন্তু এজন্য আমাদের স্বাভাবিক সৌহার্দ্যে কখনো ঘাটতি পড়ে নি, কিংবা কখনৈা রক্তারক্তি বা মারামারিও করতে হয় নি।
২.
আমার কর্মজীবনে বিশ^বিদ্যালয়ের আমার সমসাময়িক পরিচিতজন বা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা বা মহকুমা শহরের পরিচিতদের অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন আমি রাজনীতিতে জয়েন করি নি। এর উত্তরে আমি মজা করে বলি যে, রোকেয়া হল ছাত্রী সংসদের জিএস-ভিপি হওয়ার সময় থেকেই আমার ঢের আক্কেল সেলামী দেওয়া হয়ে গেছে। সঙ্গে তখনকার একটি ঘটনারও উল্লেখ করি। তখন আমি সাধারণত সকাল সাতটায় রুম থেকে বের হয়ে হলের বিভিন্ন কাজ, যেমন হল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ছাত্রীদের বিভিন্ন সমস্য সমাধান শেষে ইউনিভার্সিটিতে যেতাম। সেখান থেকে ডাকসু অফিস, বিকেলে পুরানা পল্টনে পার্টি অফিস হয়ে সন্ধ্যায় হলে ফিরে ডাইনিং হল, ছাত্রীদের সঙ্গে আড্ডা ইত্যাদি শেষ করে রুমে ফিরতে ফিরতে বেজে যেত রাত ১২টা। এর পরে রুম, বাথরুম পরিষ্কার করে গোসল ইত্যাদি সেরে ১টার আগে প্রায় কখনোই আমার ঘুমানো হতো না। একটু যখন ঘুম লেগে আসত, হয়তবা রাত তখন ৩টা, হঠাৎ আমাদের দরজায় ধাক্কা পড়ত। দরজা খুলে ‘কী ব্যাপার!’ জিজ্ঞেস করতেই কোনো ছাত্রী, বিশেষ করে ক্লাসমেইড বা সিনিয়ার কেউ জানাত, ‘আমার বাথরুমে বদনা নাই’! ছাত্রীনেত্রী হয়েও তখন আমাকে এরকম র্যাগিংয়ের শিকার হতে হতো।
বর্তমানে প্রায়ই আমি একটি সমালোচনার সম্মুখীন হই। সেটা হলো, আমি বামপন্থী রাজনীতি করতাম, এখন করি না; বরং এনজিও করি। অর্থাৎ আমি আদর্শচ্যুত হয়েছি। এ প্রসঙ্গে আমি এরকম উত্তর দিই : মার্কসিজম যদি আমি বুঝে থাকি তাহলে তার মূল মেসেজ হলো সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার জন্য কাজ করা। নারীসমাজ জনসংখ্যার অর্ধেক এবং আমি এই নারীসমাজের বিরুদ্ধে যে বৈষম্য আছে তা দূর করার কাজ করছি। সুতরাং আমি আরো বড় সাম্যবাদী।
এখন আমি যখন তৃণমূলে কাজ করতে যাই বা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর সমানাধিকার, ধর্ম, রাষ্ট্রধর্ম, হিজাব ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলি, তখনো কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হই; যেমন, এদেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলিম, তাহলে রাষ্ট্রধর্ম তো ইসলাম হতেই পারে এবং এটা হওয়াই স্বাভাবিক। এটাতে অসুবিধা কী? এ প্রশ্নে আমার জবাব হয় অনেকটা এরূপ : একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশের সকল নাগরিককে সমান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। এই মৌলিক অধিকারকে ধর্ম, বর্ণ, জন্মস্থান বা লিঙ্গপরিচয়ের ভিত্তিতে বিভাজনের সুযোগ নেই। কিংবা কারো সুযোগ নেই ১ শতাংশ নাগরিককেও এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার? সংখ্যাগরিষ্ঠতার আধিপত্যবাদ তা ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা, লিঙ্গ যে রূপেই হাজির হোক না কেন তা গণতন্ত্র পরিপন্থী। সুতরাং ‘ইসলাম’কে রাষ্ট্রধর্ম করে অন্য ধর্মের অনুসারীদের সমান মর্যাদায় ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। তা ছাড়া, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ বিশ্বাস করেন তাদের নিজ নিজ সৃষ্টিকর্তাই তাদের সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু মানুষসহ সকল প্রাণী একই পদ্ধতিতে এই পৃথিবীতে জন্মেছেন, যেখানে কোনো ধরনের বৈষম্য নেই। এমনকি যারা কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করেন না তারাও একই পদ্ধতিতে পৃথিবীতে এসেছেন। সুতরাং সকল ধর্মের সৃষ্টিকর্তাই যদি ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাদের ধর্মাবলম্বীদের পৃথিবীতে পাঠিয়ে থাকেন, তবে মানুষ কেন নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন ভিত্তিতে বৈষম্য সৃষ্টি করবে?
আবার হিজাবের প্রশ্নে আমি বলি কে কী পোশাক পরবে এটা তার তার নিজস্ব চয়েজের বিষয়। কেউ যদি হিজাব নিজের পছন্দে পরে তবে সে বিষয়ে আমার বলার কিছুই নেই। কিন্তু হিজাব পরার কারণ বা যুক্তি হিসেবে যা বলা হয় সে ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে। আল্লামা শফী যেমন নারীকে ছিলাকলা বা তেঁতুল হিসেবে দেখেন, যাকে খোলা রাখলে মানুষ খেতে চাইবে; এই দৃষ্টিভঙ্গির মর্মার্থ হলো ‘নারীরা ভোগের বস্তু’। এই দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে আমার ঘোরতর আপত্তি। নারীকে যারা মানুষ হিসেবে সমানভাবে দেখে না, সমমর্যাদা দেয় না, তাদের এই মানসিকতা অগ্রহণযোগ্য। এক কথায় এই মানসিকতা রাজাকারের মাানসিকতা, যে মানসিকতা পাকিস্তানি ভূতবাহিত হয়ে এসেছে। এই মানসিকতা আধিপত্যবাদী। আধিপত্যবাদের মানসিকতা অগণতান্ত্রিক, তা সে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প-এর শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদই হোক বা প্রধানমন্ত্রী মোদির হিন্দু ধর্মীয় আধিপত্যবাদই হোক। কিংবা হোক মুসলিম আধিপত্যবাদ বা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার আধিপত্যবাদ। এর কোনোটিই গণতন্ত্রের সঙ্গে যায় না।
আধিপত্যবাদী মানসিকতা বাংলাদেশের সংবিধান, সর্বজনীন মানবাধিকারের মৌলিক ভিত্তি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। এই আধিপত্যবাদী চিন্তাই জঙ্গিবাদের উৎস। এই হেন পাকিস্তানি ভূত যেন বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে না বসতে পারে, সেজন্য এ ধরনের চিন্তাভাবনাকে সমূলে উৎপাটন ও পরিবর্তনের কাজ করাই হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কাজ।