‘পরিবার ও পরিবারের পুরুষ সদস্য– বাবা, ভাই, স্বামী নারীর নিরাপত্তার গ্যারান্টি’– এমন প্রচলিত ধারণা মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছে। কোনো পুরুষ নারীর নিরাপত্তা দিতে পারে নি। মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারী এ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে যে, পরিবারের বাবা-ভাই-স্বামী তাদের রক্ষা করে নি ও করতে পারে নি। একদিকে যুবক ও সক্ষম পুরুষদের বাড়িতে থাকার মতো অবস্থা যুদ্ধকালে বর্তমান ছিল না, অন্যদিকে এদের একাংশ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন ও একাংশ পালিয়ে বেড়িয়েছেন আত্মরক্ষার স্বার্থে। এমনকি বাবা, ভাই বা স্বামীর কাছ থেকেও নারীদের হায়েনারা ছিনিয়ে নিয়েছে, যারা নিদারুণ নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
এটা এখন প্রমাণিত যে লক্ষ লক্ষ নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় যৌন নির্যাতনের শিকার বা যুদ্ধাহত হয়েছে, লক্ষ লক্ষ নারী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে উদ্বাস্তুর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। এর বাইরে যারা দেশে থেকে গিয়েছিলেন, তাদের বৃহদাংশ বিভিন্নভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। যারা অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধে যেতে পারেন নি, তারা অন্য গেরিলা যোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা দিয়েছেন, বৃদ্ধ ও শিশুদের সেবা দিয়েছেন, গরুবাছুর-ঘরবাড়ি-গাছপালা দেখে রেখেছেন, দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে ধরে রেখেছেন। যার অনেক দলিল আমরা পেয়েছি আমাদের গবেষণা ও সাহিত্যকর্মে, বিশেষ করে গল্প-উপন্যাসে। নারীর এই অবদানকে মনে রেখে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে আমরা যদি বাংলাদেশে নারীর স্থান নির্ধারণ করতে যাই তাহলে আমরা দেখি যে, তার অর্জন বৃহৎ। যে কয়েকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশেষভাবে সামনে এগিয়ে গেছে বলে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হয়েছে; যেমন সামাজিক উন্নয়ন, ধারাবাহিক অর্থনৈতিক গতিশীলতা, আন্তর্জাতিক মন্দার ধাক্কা সামলানো, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহার, তৃণমূল পর্যায়ের ক্ষমতায়ন, ভোটার হিসেবে সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ, পোশাক রফতানিতে প্রথম সারিতে স্থান লাভ, ইত্যাদি সবকটির পেছনেই নারীর অবদান উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতার পর প্রণীত মহান সংবিধানে জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকার স্বীকৃত হবার পর ক্রমান্বয়েই নারী দৃঢ়ভাবে সামনে এগিয়ে গিয়েছে। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ‘নারীবর্ষ’ ঘোষিত হলে সে অনুযায়ী বাংলাদেশ বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে সক্রিয় হয়। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলনে ১৯৭৬-১৯৮৫ মেয়াদের ১০ বছরকে ‘নারী দশক’ হিসেবে ঘোষণার প্রেক্ষাপটে নারী অধিকারের বিষয়গুলো উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে দেশের সর্বস্তরের নারীদের সার্বিক উন্নয়ন ও অবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি মহিলা সংস্থার রূপরেখা প্রণীত হয়, যা জাতীয় মহিলা সংস্থা নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, ১৯৯১ সালে যা একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। এই সংস্থা সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত যেসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে, তা অধিকার সচেতন করার পাশাপাশি নারীদের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। নারীদের কল্যাণে আলাদাভাবে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, জাতীয় সংসদে নারীর জন্য আসন সংরক্ষণও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নারীর সুরক্ষা ও অগ্রগতির জন্য ক্রমশ প্রণীত হয়েছে মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রিকরণ) আইন, যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন, নারী নির্যাতন (নিবর্তন) আইন, প্রাথমিক শিক্ষা (বাধ্যতামূলককরণ) আইন, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, পারিবারিক আদালত বিধিমালা, এসিড অপরাধ দমন আইন, স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) আইন, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন প্রভৃতি। নারীর অনুকূলে আইন-বিধি ও নীতিমালার মধ্যে সিডও সনদের ভিত্তিতে ১৯৯৭ সালে প্রণীত নারী উন্নয়ন নীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য পদক্ষেপ, ২০০৪-এ রাজনৈতিকভাবে নেতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হলেও পরে ২০১১-এ এসে যা পুনরায় চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়েছে। এই নারী উন্নয়ন নীতিই স্থানীয় সরকারের সংরক্ষিত আসনে নারীদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবার সুযোগ উন্মুক্ত করে দিয়েছে; যা তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের ক্ষমতায়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনার নিয়োগবিধির খসড়ায় একজন সিইসি ও দুজন কমিশনারের একজন নারী নিয়োগের বিধান রাখা, রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করে করা নির্বাচন কমিশনের বিধান, সন্তানের পরিচয়ে বাবার নামের পাশে মায়ের নাম বাধ্যতামূলক করা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে ৬০ শতাংশ নারী নিয়োগের বিধান প্রভৃতি সিদ্ধান্তও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক থেকে দেখলে বলা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে নারীরা এক্ষেত্রে ক্রমাগত যে সাফল্য অর্জন করেছে, সরকারের বর্তমান মেয়াদে তা সর্বাপেক্ষা বেশি। ১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে সরাসরি ভোটে মাত্র ৫ জন নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯১-এর নির্বাচনে ৪ জন, ১৯৯৬-এর নির্বাচনে ১১ জন ও ২০০১-এর নির্বাচনে ৬ জন নারীর বিজয়ের রেকর্ডকে টপকিয়ে ২০০৮-এর নির্বাচনে ১৯ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। এদিকে সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীতে ২০১১ সালে সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০-এ। সব মিলিয়ে চলতি সংসদে সর্বমোট ৬৯ জন নারী সংসদ সদস্য হিসেবে জাতীয় সংসদে নারীসমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী ও সংসদ উপনেতার প্রত্যেকেই নারী। হুইপ এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সদস্য হিসেবেও কাজ করছেন তাঁরা। এছাড়া বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায় এ মুহূর্তে পররাষ্ট্র, কৃষি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছেন তাঁরা।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারী ভোটারের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ১২ লাখ ৩৬ হাজার, যা পুরুষ ভোটারের চেয়েও প্রায় ১৫ লাখ বেশি। সরকারি-বেসরকারি তৎপরতায় তৃণমূলসহ সকল পর্যায়ে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ায় নারীরা ভোটার হিসেবে অংশ নিয়েছিল অন্য যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ এই নির্বাচনে নারীরাই প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন।
স্থানীয় সরকার, বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে নারীর ব্যাপকহারে অংশগ্রহণ পৃথিবীর মধ্যে নজিরবিহীন। সর্বশেষ ২০০৩ সালের পর বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দেশের চার হাজার ৫০৪টি ইউনিয়নে সংরক্ষিত কোটায় সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১৩ হাজার ৫১২ জন নারী সদস্য স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন। এর পাশাপাশি ২৩২ জন নারী চেয়ারম্যান নির্বাচন করেছেন এবং জয়ী হয়েছেন ২২ জন। সারা দেশে ৪৮২টি উপজেলার মধ্যে ৪৮১টির নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি। এর মধ্যে সংরক্ষিত কোটায় ৪৮১ জন ভাইস চেয়ারম্যান ছাড়াও সরাসরি নির্বাচনে তিনজন নারী উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন। কাজ করছেন প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত পৌর কাউন্সিলর নারীরাও। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রভাবশালী পুরুষ প্রার্থীকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হবার গৌরবজনক স্থানটিও দখল করে নিয়েছেন একজন নারী।
প্রশাসনে নারী অংশগ্রহণের চিত্র এখনো হতাশাব্যঞ্জক হলেও অংশগ্রহণের পরিমাণ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত ৮ হাজার ৬০০ জন কর্মকর্তার মধ্যে এক হাজার ২৪৬ জন নারী। সচিব ও সমমানের ৬৯ জন কর্মকর্তার মধ্যে নারী ৪ জন। ১৫৭ জন অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে নারী ৯ জন এবং ৪২৯ জন যুগ্মসচিবের মধ্যে নারী ২৭ জন। সব মিলিয়ে প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ ১৫ শতাংশ। জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে স্থানীয় প্রশাসনের প্রধান হিসেবে নারীরা সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে এক কোটি ৬২ লাখ নারী। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পউদ্যোক্তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৬ শত ৯৭ জন। বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধানতম ক্ষেত্র গার্মেন্টস খাতের ৮০ ভাগ কর্মীই নারী। দেশের ৯০ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহারকারীও নারী। অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাতের করা এক হিসেবে জানা যায়, নারী বিনা পারিশ্রমিক ও কম পারিশ্রমিকে যে পরিমাণ শ্রমদান করে, তা টাকার অঙ্গে জিডিপির শতকরা ৪৮ ভাগ। এই চিত্র নারীর অর্থনৈতিক অবদানের ব্যাপ্তিটা সামনে হাজির করে, যার মাধ্যমে জাতীয় আয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে আজ আমাদের নারীসমাজ।
মাত্র ১৪ জন সদস্য নিয়ে ১৯৭৪ যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ পুলিশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে এখন নারীরা অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ২০০৯ সালের হিসেবে পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯৩৭ জন; যাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদেও (একজন ডিআইজি, ৪ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, অতিরিক্ত এসপি ১৯ জন, সিনিয়র এএসপি ১০ জন, এএসপি ৭৭ জন, ইন্সপেক্টর ৫৩ জন, এসআই ১৮৯ জন, এএসআই ও হেড-কনস্টেবল ২৫৩ জন) অনেকে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ২০১১ সাল থেকে ৩৭১ জন সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে নতুন একটি নারী ইউনিট। একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে ১১ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের এই ইউনিটটি ৭০০-র অধিক সদস্য নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যাটালিয়ন হবার দিকে যাত্রা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে চালু হয়েছে ‘উইমেন পুলিশ নেটওয়ার্ক’। এছাড়া জাতিসংঘ শান্তিমিশন, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, স্পেশাল ব্রাঞ্চের ট্রেনিং স্কুল এবং থানার ওসি হিসেবেও সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন ও করছেন আমাদের নারীরা। নারীরা আজ সাফল্যের সাথে কাজ করে চলেছেন সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীতেও, যাঁদের অনেকে গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্বে নিয়োজিত।
আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবেও নারীরা সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করছেন অনেকে।
বর্তমান সরকারের মেয়াদে গঠিত তথ্য কমিশনে কমিশনার হিসেবে কাজ করছেন একজন নারী। জেলা তথ্য বাতায়ন এবং জাতীয় ই-তথ্যকোষ বর্তমান সরকারের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ই-তথ্যকোষ তথ্যপ্রযুক্তির সাথে পরিচিত নারীর হাতে তার জীবন ও কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সব ধরনের তথ্য (কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন ও মানবাধিকার, নাগরিক সেবা, পর্যটন, অকৃষি উদ্যোগ, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শিল্প ও বাণিজ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান) পৌঁছে দিয়েছে, যা তাদের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। সাংবাদিকতার মতো পেশায় সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। এটা ঠিক যে, মুদ্রণ ও বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারী অংশগ্রহণ এখনো প্রায় নেই বললেই চলে। তবু নারীদের এই খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অংশগ্রহণ তাদের সমস্যা, সম্ভাবনা ও অর্জনকে গণমাধ্যমে হাজির করার ক্ষেত্রে অনুকূলতা দিয়েছে।
শিক্ষাখাতে বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খুবই প্রশংসনীয়, তবে সেটা বিদ্যালয়ে ভর্তি ও পাসের ফলাফল অর্জনের দিক থেকে। তবে দারিদ্র্য, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, পরিবারের অনাগ্রহ, বাল্যবিয়ে প্রভৃতি কারণে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হতে না-হতেই বিদ্যালয় থেকে মেয়েদের ঝরে পড়ার প্রবণতা এখানে এখনো উল্লেখযোগ্য। এ অবস্থা চর ও হাওর এলাকার মতো প্রত্যন্ত ও অনগ্রসর অঞ্চলে বেশি। তবে উচ্চশিক্ষাস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো সার্বিকভাবেই কম। বেনবেইসের ২০১১-এর হিসেব অনুযায়ী, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েশিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ যেখানে ৫০.৫০ ও ৫৩.৬১ শতাংশ, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে মেয়েশিক্ষার্থী মাত্র ২৯.৯৮ শতাংশ। পেশাগত এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায়ও তাদের অংশগ্রহণ এখনো খুব একটা বাড়ে নি। এ হার যথাক্রমে মাত্র ৩৬.৪২ ও ২৭.০২ শতাংশ। এ সময়ের আরেকটি প্রবণতা লক্ষণীয় যে, মাদ্রাসায় মেয়েদের অংশগ্রহণ আগের চেয়েও বেড়েছে। বেনবেইস রিপোর্ট বলছে, এ হার ২০১১-এ ছিল ৫৩.২৩ শতাংশ। আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, মাদ্রাসায় পড়া মেয়েরা শিক্ষিত হলেও তাদের মুক্তচিন্তার দুয়ার সেভাবে উন্মোচিত হয় না। নারীর সমানাধিকার ও ক্ষমতায়নের আন্দোলনে মেয়েদের এ অংশ অনুকূল শক্তি হিসেবে যুক্ত হয় না।
গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে পর্যাপ্ত পরিমাণে জেন্ডার অসংবেদনশীল উপাদান রয়ে গেছে। যেমন, পাঠ্যবইয়ের পিতা যখন সম্পত্তি বা অর্থের ভাগবাটোয়ারা করেন, তখন ছেলে যত বড়ো ভাগ পায়, মেয়ে ততটা পায় না। নারী-পুরুষ উভয়কে যখন কর্মরত দেখানো হয়, তখন পুরুষকে বিমান চালনায় দেখানো হলেও মেয়েকে দেখানো হয় রান্নাবান্না করতে। পাঠ্যপুস্তক যাঁরা প্রণয়ন করেন, যাঁরা এর জন্য ছবি আঁকেন, যাঁরা সম্পাদনা করেন তাঁদের মনোগঠনে যে পুরুষতান্ত্রিকতা জায়গা করে নিয়েছে, প্রকারান্তরে তার ছাপই পাঠ্যপুস্তকে মুদ্রিত হয়ে যায়। কী ছেলে কী মেয়ে উভয়েই এসব উপাদানের কারণে নারী-পুরুষ সম্পর্ক বিষয়ে শৈশব থেকেই নেতিবাচক ধারণা লাভ করতে শুরু করে। ছেলেরা মেয়েদের তাদের চেয়ে হীন ভাববার অবকাশ পায়, বিপরীতে মেয়েরা ভোগে হীনম্মন্যতায়। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নারীবিরোধী মনোভাব বিকাশে এই শিক্ষাব্যবস্থারও ভূমিকা আছে। নতুন করে প্রকাশিত পাঠ্যবইয়ে এসব উপাদান একটু একটু করে কমে আসলেও পরিপূর্ণভাবে জেন্ডার সংবেদনশীল পাঠ্যপুস্তকের জন্য আমাদের আরো কাজ করে যেতে হবে। তা না হলে একদিকে আমরা বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণে কাজ করে যেতে থাকব, অন্যদিকে সকল শিশুর মাথায় বৈষম্যের বীজ বপন করা হতে থাকবে।
বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। নারীদের জন্য এটা অনেক বেশি হতাশাব্যঞ্জক। এ সমাজ নারীকে তার অসুখ গোপন করতে ও সহ্য করতে শেখায়। এভাবে অসুখ যখন ভয়ানক হয়ে ওঠে, তখনো প্রায়ই তাদের জন্য জোটে না আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ। ঝাক-ফুঁক, তাবিজ-কবিরাজ এদেশে আজো নারীদের চিকিৎসার প্রধান ক্ষেত্র। সমাজ নারীর সুস্থ থাকার প্রয়োজনকেই আজো গৌণ করে দেখে। যেজন্য একই পরিবারে একইরকম স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছেলের দেখা দিলে যে ব্যবস্থা, মেয়ের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা ভিন্ন হয়। যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যার ক্ষেত্রে লুকোছাপা করতে হওয়াই যেন সামাজিক রীতি। অথচ প্রজননতন্ত্রের যেকোনো রোগ ভবিষ্যৎ জীবনে মারাত্মক কুপ্রভাব ফেলতে পারে। এ ধরনের সমস্যায় নিজেরা উদ্যোগী হয়ে চিকিৎসকের কাছে যাবার ক্ষেত্রেও নারীর জন্য নানা বাধা আছে। প্রথমত, পরিবার প্রায়ই নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবার স্বাধীনতাকে মেনে নেয় না; দ্বিতীয়ত, এদেশের সিংহভাগ নারীরই পরিবারের অন্য কারো অর্থ সহযোগিতা ছাড়া নিজ খরচে চিকিৎসা করবার সামর্থ্য নেই; তৃতীয়ত, যৌনরোগের চিকিৎসা করানোর খবর রাষ্ট্র হলে সমাজে দুর্নাম ছড়াবার সম্ভাবনা থাকে; এবং চতুর্থত, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো এ ধরনের চিকিৎসার জন্য গেলে মেয়েদের সাথে পেশাদারি আচরণ করে না।
বাংলাদেশে প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার গত কয়েক বছরে অনেকটা কমেছে। বর্তমানে এই হার বছরে প্রতি লাখে ১৯৪ জন, ২০০১-এ যা ছিল ৩২২। যদিও এক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে, তারপরও এই মাতৃমৃত্যু অগ্রহণযোগ্য। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে চিকিৎসাহীনতা কিংবা অবহেলায় একজন মা মারা যাওয়াও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অপ্রতুলতা, যাতায়াতের অব্যবস্থা, সামাজিক সংস্কার, পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধজনিত অবহেলা, শরীর পরিণত হবার আগেই গর্ভধারণ করতে বাধ্য হওয়া, ইত্যাদি কারণে এ ধরনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে। ২০১৫ সালের মধ্যে সহস্রাব্ধ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এই হার ১৪৩-এ নামিয়ে আনতে হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ করতে হবে।
সম্প্রতি কেয়ারের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে শুধু নারী নির্যাতনের কারণে প্রতি বছর ১৪ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা খরচ হয়, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। এ চিত্র দেশে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতারই স্মারক বহন করে, যে বর্বরতা এদেশে এখনো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। স্বীকার করতে বাধা নেই যে, হাজার বছর ধরে টিকে থাকা বৈষম্যমূলক সংস্কৃতি নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। এই বৈষম্য সম্পূর্ণভাবে অপনোদন করা না-গেলে নারী নির্যাতন পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। যতদিন সেটা না হচ্ছে ততদিন সচেতনতা সৃষ্টি, বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নির্যাতনমূলক ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা সম্ভব হলেও মূল লক্ষ্যটা পরিকল্পিত হওয়া উচিত বৈষম্য বিলোপের জন্যই।
বর্তমান সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির তৃতীয় পর্ব বাস্তবায়নে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়-এর অধীনে পরিচালিত এই প্রকল্পের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বেসরকারি সংস্থাসমূহের সাথে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতনে সহিংসতা হ্রাস করা এবং সেবা কার্যক্রম জোরদারকরণ; নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে সমন্বিত গুণগতমানসম্পন্ন, দক্ষ ও টেকসইসেবা প্রদান; সমন্বিত/আন্তঃমন্ত্রণালয় উদ্যোগের মাধ্যমে নারী নির্যাতন সম্পর্কিত কার্যক্রম গ্রহণে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ; নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন ও প্রক্রিয়াগত সংস্কার অর্জন এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা।
প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যেই আটটি মেডিকেল কলেজে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিসি সেন্টার (ওসিসি) স্থাপন এবং জেলা পর্যায়ে ৪০টি ও উপজেলা পর্যায়ে ২০টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল খোলা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি ও অন্য সাতটি মেডিকেল কলেজে বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার স্থাপন, নির্যাতিতদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ, নারী নির্যাতন বিষয়ক জাতীয় ডাটাবেইজ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার (হটলাইন ১০৯২১) স্থাপন করা হয়েছে। এর বাইরেও চলছে নির্যাতন প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও নির্যাতনবিরোধী গণসচেতনতা কার্যক্রম। ইতোমধ্যে পাস হয়েছে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০। এই সবকিছু মিলিয়ে সরকারি যে তৎপরতা দৃশ্যমান হচ্ছে তা নারী নির্যাতন প্রতিরোধে একটা ভালো সুফল দেবে বলেই আশা করা যায়। তবে আমাদের মনে হয়, এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যদি অর্থ মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করা হতো এবং সমাজে বিদ্যমান সার্বিক বৈষম্য বিলোপের জন্য প্রকল্পের আওতায় কোনো দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারিত হতো তাহলে সুদূরপ্রসারী অর্জনের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারত। সেটা হওয়া জরুরিও। কারণ নির্যাতন ও বৈষম্যময় পরিবেশ নারীর ক্ষমতায়নের অনেক বড়ো অন্তরায়।
জাতীয় বাজেট দেশের সকল মানুষের বাজেট। কিন্তু ২০০০ সাল থেকে নিয়মিত জাতীয় বাজেটের লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, জাতীয় বাজেটের স্বার্থ মূলত পুরুষদের দিকেই ধাবিত হয়। কারণ বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা পুরুষের সমস্তরে নেই। সেজন্য নারীসমাজের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি ছিল, নারীকে চিহ্নিত করে বাজেট ঘোষণা করা। গত কয়েক বছর ধরে বিদ্যমান অবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে, যেটা আশাব্যঞ্জক। সর্বশেষ ২০১২-’১৩ অর্থবছরে মোট ২৫টি মন্ত্রণালয়ের জেন্ডারভিত্তিক বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে জাতীয় সংসদে। এ প্রক্রিয়ায় ক্রমশ সবকটি মন্ত্রণালয়ের বাজেটই জেন্ডারভিত্তিক করা হবে বলে আমরা আশা করি। তাছাড়া আমাদের বাজেটের আরেকটা বড়ো দুর্বলতা হলো সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট বরাদ্দ যথাযথভাবে ব্যয় করতে না-পারা। যদি বাজেট ব্যয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি না-করা হয় এবং ব্যয়িত বাজেট কতটা প্রভাব রাখল তা মনিটর করা না-হয়, তাহলে নারীর জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি ও জেন্ডারভিত্তিক বাজেট নির্ধারণও তেমন সুফল বয়ে আনতে পারবে না।
নারীর ক্ষমতায়ন বলতে সমগ্র নারীসমাজের ক্ষমতায়নকে বুঝতে হবে এবং সেক্ষেত্রে উল্লিখিত সবকটি বিষয়কেই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত করে দেখা দরকার। অবশ্য এটা ঠিক যে, নারীদের মধ্যকার একটা ক্ষুদ্র অংশ আজ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অংশত ক্ষমতায়িত হয়েছেন। সময়ের পরিক্রমায় বর্তমান অবস্থায়ও এ সংখ্যা আরো বাড়বে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা এ গতিতে সন্তুষ্ট থাকতে পারছি না। গতি আরো বাড়াতে হবে, সেজন্য বড়ো বড়ো প্রতিবন্ধকতা দূর হবার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে।
নারী আজও যেমন উত্তরাধিকারে সমঅধিকার অর্জন করতে পারে নি; এমনকি একমাত্র সন্তান মেয়ে হলেও সে সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার পায় না। এই বিধান সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। নারীর ক্ষমতায়নকে এগিয়ে নিতে এবং সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য নারীকে এ অধিকার দিতে হবে। সেজন্য প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে।
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী রাজনৈতিক দলসমূহের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ৩৩ শতাংশ নারীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করবার উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ১০০ করা ও এসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে এলে নারী সংসদ সদস্যদের জনসম্পৃক্ততা বাড়বে। তাতে টেবিল চাপড়িয়ে বা কণ্ঠ উঁচিয়ে দলকে ভোট দেয়াই তাঁদের প্রধান কাজ হবে না, বরং রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও জনগণের প্রতি জবাবদিহিতার মানসিকতা তৈরি হবে। উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের কার্যক্রমের পথে দেখা দেওয়া বাধাগুলো অপসারণেও।
আগেই বলা হয়েছে, বর্তমান সরকার ও সংসদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজগুণে আজ নারীরা অধিষ্ঠিত হয়েছেন। প্রশাসনের অনেক শীর্ষস্থানীয় পদেও আজ নারীরা আছেন। এর বাইরে বেসরকারি পর্যায়েও অনেক বড়ো বড়ো করপোরেট ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ভার আজ সাফল্যের সাথে সামলাচ্ছেন নারীরা। সরকারি-বেসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে নারীরা হাল ধরে আছেন। অনেকে সাহিত্যিক-সাংবাদিক হিসেবে দেশজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। অপ্রচলিত পেশা ও কাজেও আজ অনেক নারী কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন; এমনকি সর্বশেষ এভারেস্টশৃঙ্গ জয় করেও আমাদের বোনেরা দেখিয়েছে যে, তারা নিষ্ঠা ও যোগ্যতায়ও আজ আর কারো থেকে পিছিয়ে নেই। এই গতিটাকে আমাদের আরো সামনে এগিয়ে নিতে হবে। সেজন্য নারীদের কোনো অন্যায্য সুবিধার দরকার নেই, দরকার কেবল তার চারপাশে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো আছে সেগুলো দূর করবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। এরকম একটি বাধা হলো নারীর কাঁধে চেপে বসা গার্হস্থ্য ও প্রজনন কর্মভার। সনাতনী এই কর্মভার নারীকে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখে।
যদি গার্হস্থ্য দায়-দায়িত্বগুলো পরিবারের সবাই মিলে ভাগ করে করবার সংস্কৃতি তৈরি করা যায়, তাহলে নারী নিজেকে বিকশিত করবার সুযোগ পাবে। গার্হস্থ্য দায়িত্ব পালন সহজ করার জন্য প্রত্যেক ঘরে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সুব্যবস্থাপনা পৌঁছে দিতে হবে। পর্যাপ্ত শিশু দিবাযতœকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে, যাতায়াত সুগম করতে হবে। এসব করা হলে সংসার সামলিয়েও নারী অন্য কাজে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে অংশ নিতে পারবে। তাছাড়া এতে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা গার্হস্থ্য দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। এর বাইরে বিয়ে করা না-করা এবং কটি সন্তান কখন নেবে না-নেবে ইত্যাদি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবার স্বাধীনতা যদি নারীরা ভোগ করতে পারে, তাহলে তাদের এই ক্ষমতায়নের পথে অগ্রসর হওয়া আরো একটু সহজ হবে। আর এসব সুযোগ সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র নারীদের দিয়েই রেখেছে, এখন দরকার আমরা যারা তাদের সেই সুযোগ ভোগে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছি প্রতিনিয়ত, তাদের এ কাজে নিরস্ত হওয়া।