ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন হয়রানির খবরে প্রতিদিনকার পত্র-পত্রিকাই সয়লাব থাকে। এসব খবরের কিছু নমুনা, যেমন বৃদ্ধ কর্তৃক শিশু ধর্ষণ, প্রেমিক কর্তৃক ধর্ষণ, ডাক্তার কর্তৃক রোগী ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, অফিসের বস কর্তৃক সহকর্মীকে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ, গাড়িচালক ও কন্ডাক্টর কর্তৃক নারী যাত্রী ধর্ষণ। আমরা উদ্বেগজনকভাবে দেখছি ছাত্রীর ধর্ষক হয়ে উঠছে স্কুল-কলেজের শিক্ষক, মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ও শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গীর্জার পাদরী। এমনকি পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-পরিজন তথা দুলাভাই, বাবা, চাচা, মামা, শ্বশুর, দেবর, ভাসুরের লালসার হাত থেকেও নারী ও শিশুরা রক্ষা পাচ্ছে না। রাজনৈতিক সংগঠন ও ছাত্র সংগঠনের কর্মী ও বিভিন্ন কিশোর গ্যাং, শ্রমিক সংগঠনের কর্মী— কে নয় এই ধর্ষণযজ্ঞে শরিক? এ যেন ঠগ বাছতে গা উজাড় হবার জোগাড়। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন এতিমখানা, মাদ্রাসা ও হোস্টেলে বাচ্চা ছেলেদের উপর বলাৎকার। তবে আজকের এই লেখা নারীর উপর ধর্ষণ ও হয়রানিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
সবাই জানে, যত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তার সবটাই সংবাদ হয় না। অর্থাৎ পত্র-পত্রিকায় আমরা যেসব সংবাদ দেখি, তা সংঘটিত ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনার একটা অংশ মাত্র। সাধারণত মামলা হলেই ঘটনার সংবাদ পত্র-পত্রিকায় আসে। অথবা পত্র-পত্রিকায় আসলে মামলা হয় এবং পুলিশ প্রশাসন একটু তৎপর হয়। কিন্তু সব ধর্ষণ ঘটনায় মামলা হয় না, কারণ মামলা করায় অনেক ঝামেলা। মামলা চলাকালীন ভিকটিম নারীকেই জেরার নামে যেভাবে হেনস্থা করা হয় তার জন্যও অনেকে মামলার ঝামেলায় যেতে চান না। তা ছাড়া মামলা করেও অনেক ভিকটিম বিচার পায় না ও বিচার না পেয়ে আত্মহত্যা করে। অনেক সময় প্রভাবশালীরা সালিশের নামে ধর্ষকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে, ভিকটিমকে কলংকের ভয় দেখিয়ে সালিশের মাধ্যমে ঘটনার নিষ্পত্তি করে। ধর্ষকের বিচার না করে সালিশ-এর মাধ্যমে সমঝোতা বা ধর্ষক-এর সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করে, অনেক সময় এই অপমান সইতে না পেরে ভিকটিম আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
ধর্ষণ ঘটনায় প্রায়ই সবকিছু ছাপিয়ে ঘটা করে ভিকটিম নারী বা মেয়েটি কী ধরনের পোশাক পরেছিল, কীভাবে চলাফেরা করত, কোথায়-কোথায় যেত, তার ছেলেবন্ধু ছিল কি না, রাতে বাইরে বের হতো কি না, সিগারেট খেত কি না ইত্যাদি আলোচনা প্রাধান্য পায়। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো ধর্ষণ ঘটনার যৌক্তিকতা প্রমাণ করা, যেন কেউ আঁটোসাঁটো পোশাক পরলে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করলে, ছেলেবন্ধু থাকলে বা রাতে বাইরে বেরোলে ধর্ষণ জায়েজ হয়ে যায়। এমনকি আমরা দেখি, কোনো অপরাধ করে যদি কোনো নারী বিচারে সোপর্দ হয়, সেখানেও অপরাধ-এর চাইতে সবার কাছে অভিযুক্ত নারীর পরিধেয় ও জীবনাচরণই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। আমাদের গণমাধ্যমগুলোও অনেক সময় এসব বিষয়ে প্রশ্ন তোলে না, বরং বিকৃত মানসিকতার এসব ব্যক্তিদের কৌতূহলের খোরাক জুগিয়ে চলে।
এরকম বাস্তবতায় প্রায় সব মহলে আলোচনায় উঠে আসে যে ধর্ষকের কঠোর বিচার হয় না বলেই এত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। তাহলে সৌদি আরবে কঠোর শাস্তি শিরচ্ছেদ-এর পরও আমাদের নারীকর্মীরা ধর্ষণের শিকার হয়ে দেশে ফিরত না। একথা অস্বীকার করবার জো নেই যে, ধর্ষণ ঘটনার প্রতিবিধানে দেশে আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। এটা ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বৃদ্ধির একটা বড় কারণ। তা ছাড়া রাজনৈতিক প্রশ্রয়, যখন যে ক্ষমতায় থাকে সেই দলের নাম ব্যবহার বা তাদের আশ্রয় ও প্রশাসনের আশ্রয় বা নির্লিপ্ততা ইত্যাদিও আরেক বড় কারণ। তবে আমরা অনেকেই জানি, কেবল কঠোর বিচার দিয়েই ধর্ষণ থামানো যাবে না। কারণ ধর্ষণের অন্যতম মূল কারণ আমাদের সমাজ মানসিকতা। যে মানসিকতায় নারীকে মর্যাদাশীল মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হয় না, ভোগের সামগ্রী হিসাবে দেখা হয়। এর মূলে রয়েছে পুরুষের সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদ— পরিবার, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, শিক্ষা, সামাজিক ও ব্যবসায়িক সব সংগঠন, ধর্মীয় সব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্যবাদ। এই আধিপত্যবাদ সমাজ, সংস্কৃতি ও মনোজগতে এমন ভাবনা সৃষ্টি করেছে যে পুরুষ যা চায় তা পাওয়ার অধিকার স্বতঃসিদ্ধ। সেটা অধস্তন হিসেবে নারী জোগাতে বাধ্য। সেটা বিকৃত যৌনক্ষুধা বা অন্য যে কোনো সেবাই হোক না কেন। এর একটা উদাহরণ স্বৈরাচারী এরশাদ-এর স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন নারীর সঙ্গে যে সম্পর্ক সে খবরে তখনকার গণমাধ্যম সয়লাব ছিল। ঐ সময়ে নির্বাচনে রংপুরে তার পক্ষের মিছিলের জোয়ারে একজন সাংবাদিক এক নারীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এরশাদের এই চরিত্রের কথা জেনেও আপনারা তাকে ভোট দেবেন? উত্তর ছিল— “এরশাদ আমাগো রংপুরের ছাওয়াল। ছাওয়াল গো এ রকমের অভ্যাস থাকেই, এটা দোষের কিছু নয়”। এবং এই মাসসিকতায়ই বাস বা টেম্পোর হেল্পার পর্যন্ত নারীদের গায়ে অবলীলায় হাত চালায় এবং অন্য যাত্রীরা তার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করে না, এটাকে গ্রহণও করে। তা না হলে সামান্য ঘটনায় তথাকথিত “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত” লেগেছে এই অজুহাতে যেখানে হাজার হাজার লোক নিমেষেই রাস্তায় নেমে পড়তে পারে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করার জন্য, সেখানে সিলেট এমসি কলেজের ঘটনায় কেন মানুষ এগিয়ে এল না? এর প্রধান কারণ একটাই— নারীকে মানুষ না ভাবা, সমান নাগরিক হিসাবে তার সমমর্যাদা অস্বীকার করা থেকেই এই অবস্থার সৃষ্টি।
সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে গত ২৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় যে ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানেও যে প্রবণতা কাজ করে তা হলো একজন নারী একজন পুরুষ একসাথে দেখলেই তাদের সম্পর্কের প্রতি অনাবশ্যক কৌতূহল। এবং তথাকথিত অনৈতিকতার এই মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে, অনৈতিকতার অজুহাত দাঁড় করিয়ে ধর্ষণের তথাকথিত যৌক্তিকতা দাঁড় করানো। খবরে প্রকাশ, ঘটনার শিকার নারী তার স্বামীর সাথে নিজেদের গাড়িতে করে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। সিলেটের টিলাগড়ে অবস্থিত এমসি কলেজে গেটের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তারা কিছু কেনার জন্য নেমেছিলেন। সেখানে এসে অভিযুক্ত ধর্ষকরা অনাবশ্যকভাবে তারা স্বামী-স্ত্রী কিনা এই প্রশ্ন করে ও স্বামীকে আটকে রেখে কয়েকজন মিলে ওই নারীকে জোর করে পালাক্রমে ধর্ষণ করে।
প্রশ্ন হলো দুজন নারী-পুরুষ একত্র কোথাও বেড়াতে গেলে বা বাইরে বেরোলে তাকে কেউ এরকম জেরা করতে পারে কি না? সে অধিকার কারো নেই। দুজন নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা বা বন্ধু যাই হোক, তাদের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করা বা হয়রানি করার কোনো অধিকার কারো নেই। এমন হয়রানি পুলিশরাও মাঝে মাঝে করে থাকে, দুজন ছেলে মেয়েকে একসাথে দেখলে এ ধরনের প্রশ্ন করে বিব্রত করে এবং টাকা আদায় করে। এমনকি পুলিশ সদস্যদের এরকম অপতৎপরতা আমরা প্রায়ই দেখি পার্কে, নদী তীরে ও বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে। আইনের লোক হয়ে পুলিশের এরকম বেআইনি তৎপরতা সাধারণ মানুষকেও এসবে উৎসাহিত করে। পুলিশ সদস্যদের তৎপর হওয়া আইনত যে সমস্ত ঘটনায় দরকার এরকম অজস্র ঘটনা সবসময় চারপাশে ঘটছে। কিন্তু সেসব ব্যাপারে তাদের কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায় না। তাদের চোখের সামনে দিয়ে খুন, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা ও দুর্নীতির আসামি ঘুরে বেড়ায়। সব মানুষ তাদের দেখতে পায় কিন্তু পুলিশ তাদের খুঁজে পায় না। সাধারণ নাগরিকদেরও করবার মতো অনেক কাজ আছে, কিন্তু তারা সেসব করে না। যেমন, এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের পাশের আবাসিক এলাকার এক বাসিন্দার বরাতে জানা যায়, রাতে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ছাত্রাবাসের ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি ও কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু তারা সেখানে এগিয়ে আসেনি। আবাসিক এলাকার লোকজন দলবদ্ধভাবে এগিয়ে এলে হয়ত ওই নারী ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পেত। তাই পরিবার, সমাজ, কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় নারীকে সমান চোখে দেখতে পারার যে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বা চিন্তাধারা তা ছড়িয়ে দিতে হবে। পুলিশ থেকে শুরু করে প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা সকলকেই এ বিষয়ে সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে। আর এখানে রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তারা যদি এই ধর্ষকদের তাদের নাম ভাঙাতে না দেয় এবং এই সমস্ত অপরাধীর বিরুদ্ধে কাজ করেন, তখন সাধারণ মানুষও তাদের সঙ্গে যুক্ত হবেন। তখন ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনার বিচার ত্বরান্বিত হবে এবং এ সমস্ত ঘটনা কমে আসবে। তাহলেই আমাদের বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন সফল হবে।