প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে আমাদের যেমন গর্ব, তেমনি অসন্তুষ্টিরও অন্ত নেই। এই অর্থে অসন্তুষ্টি যে, এ শিক্ষা পরিপূর্ণ জীবনদৃষ্টি বা জীবনদক্ষতা অর্জনে কার্যকর কোনো সহযোগিতা করে না। শিক্ষকগণ একাডেমিতে বদহজম হবার মতো প্রচুর জিনিস না-বুঝিয়ে কেবল গলাধঃকরণ করিয়ে ভাবেন, শিক্ষার্থীদের বুঝি বেশ ভারী একটা শিক্ষাই অর্জিত হলো! শিক্ষার্থীরাও সর্বোচ্চ শ্রেণির সনদপত্র হাতে নিয়ে ভাবে, এবার হয়ত জানাবোঝাটা একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ পেল। এই প্রাক-ধারণা নিয়ে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে যাওয়ামাত্রই সদ্য পাস করা ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারে যে, প্রয়োজনীয় অনেক কিছু সম্পর্কেই তাদের কোনো ধারণা নেই; একাডেমি থেকে জীবনঘনিষ্ঠ খুব কম শিক্ষাই তাদের লাভ হয়েছে।

সমাজ বদলের জন্য কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের যে ধরনের নারী-পুরুষ কর্মীবাহিনীর দরকার হয়, সে ধরনের মানুষের একটা তীব্র সংকট আমরা শুরু থেকেই বোধ করে এসেছি। অথচ চারপাশে উচ্চ ডিগ্রিধারী নারী-পুরুষের সংখ্যা চোখে পড়ার মতোই। এই পরিপ্রেক্ষিতের ওপর দাঁড়িয়ে কেবল সনদ অর্জন করাকেই আমরা প্রকৃত শিক্ষা বলতে নারাজ। এ উপলব্ধি ছিল বেগম রোকেয়ারও। তাঁর মতিচুর গ্রন্থের ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধে তিনি বলে গেছেন : ‘আমরা কেবল “পাশ করা বিদ্যা”কে প্রকৃত শিক্ষা বলি না।’ তাঁর এই বিখ্যাত প্রবন্ধটির প্রাথমিক রূপটি ‘আমাদের অবনতি’ নামে মাসিক নবনূর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ১৩১১ সালে, পরে যেটা ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ নামে তাঁর মতিচুর গ্রন্থভুক্ত হয়। আজ যখন এই লেখা লিখছি তখন বাংলা ১৪১৮ সাল। অর্থাৎ ১০৭ বছর পরও সনদপত্রের স্তরের সাথে অর্জিত প্রকৃত শিক্ষার স্তরের মাত্রাগত হেরফের প্রকটভাবে দৃশ্যমান। তাঁর চিন্তাভাবনা যে এখনো খুব প্রাসঙ্গিক, তা এখানে এসেও বিশেষভাবে উপলব্ধি করা যায়।

বেগম রোকেয়া তৎকালীন প্রেক্ষাপটে কথাটি বলেছিলেন কেবল মুসলিম নারীদের উদ্দেশে, আজ আমরা এ কথা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল নারী-পুরুষের কথা মনে রেখেই বলতে পারি, যখন বুঝতে পারি যে, স্নাতকোত্তর পাস করে আসা ছেলেমেয়েরা জেন্ডার, নারীর সমানাধিকার, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার, দেশের সংবিধান, আন্তর্জাতিক আইন, এমনকি দৈনন্দিন প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা সম্পর্কেও প্রায় কোনো ধারণা রাখে না। এ অবস্থা নিঃসন্দেহে অপ্রত্যাশিত।

নাগরিকদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও পাসের হার নিয়েই মোটের ওপর সন্তুষ্ট থাকতে দেখা যায়। একইভাবে অভিভাবকরাও জোর দেন তাদের সন্তানদের যেকোনো মূল্যে ভালো পাস করার ওপরেই। শিক্ষকদের চাওয়া এই দুই কর্তৃপক্ষের চাওয়ার বাইরের কিছু হওয়ার সুযোগ কম। কারণ তাঁদের পারিশ্রমিকটা আসে এই দুই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই। এই চক্রের মধ্যে পড়ে শিক্ষার্থীরাও যেকোনোভাবে একটা ভালো পাস দেবার চেষ্টায়ই মনোযোগী হয়। কেউ ঠেসে মুখস্থ করে আর কেউ-বা পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করবার প্রস্তুতি নেয় ও তাতে হাত পাকায়। আর পাস করে বেরোবার পর একটা ভালো কাজ পাবার চেষ্টায় যারপরনাই গলদঘর্ম হয়। 

ওই একই প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া বলেছেন, ‘“শিক্ষা”র অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষের “অন্ধ-অনুকরণ” নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা (faculty) দিয়াছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি (develop) করাই শিক্ষা। ঐগুণের সদ্ব্যবহার করা কর্ত্তব্য এবং অপব্যবহার করা দোষ। ঈশ্বর আমাদিগকে হস্ত, পদ, কর্ণ, মনঃ এবং চিন্তাশক্তি দিয়াছেন। যদি আমরা অনুশীলন দ্বারা হস্তপদ সবল করি, হস্ত দ্বারা সৎকার্য্য করি, চক্ষু দ্বারা মনোযোগ সহকারে দর্শন (বা observe) করি, কর্ণ দ্বারা মনোযোগ পূর্ব্বক শ্রবণ করি, এবং চিন্তাশক্তি দ্বারা আরও সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করিতে শিখি– তাহাই প্রকৃত শিক্ষা।’ তাঁর এই কথাকে উল্লিখিত বিবেচনায় আমাদের বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। কী ছেলে, কী মেয়ে, তারা যদি বেগম রোকেয়ার চোখে শিক্ষাকে দেখে নিজেকে কীভাবে তৈরি করতে হবে তা বুঝে নেয় এবং সে অনুযায়ী অভিনিবেশী হয়, তাহলে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে থেকেও তারা নিজেকে একজন প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে। অবশ্য শিক্ষার্থীবিশেষের অভিনিবেশী হওয়াই এক্ষেত্রে শেষ সমাধান নয়। সেজন্য ভর্তি হওয়া ও পাস করার সাফল্যের চাইতে শিক্ষার্থীদের ইন্দ্রিয়সমূহের সর্বোচ্চ ব্যবহারের প্রতিই শিক্ষা-কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হওয়া দরকার, যাতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীই দেখতে, শুনতে ও বলতে পারার উচ্চদক্ষতা অর্জন করতে পারে এবং যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে শিখবার প্রেরণা ও পরিবেশ পায়। এরকম করা হলে প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের দ্বারটা উন্মোচিত হবে বলে আমাদের মনে হয়। প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের দ্বার উন্মোচিত হওয়া দরকার প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ তৈরি করবার জন্যই। আর প্রকৃত শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের পার্থক্যটা বেগম রোকেয়া শতবর্ষ আগেই সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে রেখে গেছেন : ‘যেখানে অশিক্ষিত চক্ষু ধূলি, কর্দ্দম ব্যতীত আর কিছুই দেখিতে পায় না, সেখানে (বিজ্ঞানের) শিক্ষিত চক্ষু অনেক মনোরম চমৎকার বস্তু দেখিতে পায়। আমাদের পদদলিত যে কাদাকে আমরা কেবল মাটি, বালি, কয়লার কালি ও জলমিশ্রিত পদার্থ বলিয়া তুচ্ছজ্ঞান করি, বিজ্ঞানবিদ্ তাহা বিশ্লিষ্ট করিলে নিম্নলিখিত বস্তু চতুষ্টয় প্রাপ্ত হইবেন। যথা– বালুকা বিশ্লেষণ করিলে সাদা পাথর বিশেষ (opal); কর্দ্দম পৃথক করিলে চিনে বাসন প্রস্তুত করণোপযোগী মৃত্তিকা, অথবা নীলকান্তমণি; পাথর-কয়লার কালি দ্বারা হীরক এবং জল দ্বারা একবিন্দু নীহার! দেখিলেন, ভগিনী! যেখানে অশিক্ষিত চক্ষু কর্দ্দম দেখে, সেখানে শিক্ষিত চক্ষু হীরা-মাণিক দেখে!’

বলতে কী, আমরা শুধু কর্দম দেখার উপযোগী রাশি রাশি চোখ চাই না, বরং চাই হীরা-মাণিক দেখার উপযোগী চোখ, যেরকম চোখ বেগম রোকেয়ার নিজের ছিল।

২.
স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধের আরেকটি জায়গায় বেগম রোকেয়া জানিয়েছেন, ‘অনেকে মনে করেন যে, পুরুষের উপার্জ্জিত ধন ভোগ করে বলিয়া নারী তাহার প্রভুত্ব সহ্য করে। কথাটা অনেক পরিমাণে ঠিক। বোধ হয়, স্ত্রীজাতি প্রথমে শারীরিক শ্রমে অক্ষম হইয়া পরের উপার্জ্জিত ধনভোগে বাধ্য হয়। এবং সেইজন্যে তাহাকে মস্তক নত করিতে হয়। কিন্তু এখন স্ত্রীজাতির মন পর্য্যন্ত দাস (enslaved) হওয়ায় দেখা যায়, যে স্থলে দরিদ্রা স্ত্রীলোকেরা সূচিকর্ম বা দাসীবৃত্তি দ্বারা অর্থ উপার্জ্জন করিয়া পতি পুত্র প্রতিপালন করে, সেখানেও ঐ অকর্ম্মণ্য পুরুষেরাই “স্বামী” থাকে। আবার যিনি স্বয়ং উপার্জ্জন না করিয়া প্রভূত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণীকে বিবাহ করেন, তিনিও ত স্ত্রীর উপর প্রভুত্ব করেন এবং স্ত্রী তাঁহার প্রভুত্বে আপত্তি করেন না। ইহার কারণ এই যে বহুকাল হইতে নারী-হৃদয়ের উচ্চ বৃত্তিগলি অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ায় নারীর অন্তর, বাহির, মস্তিষ্ক, হৃদয় সবই “দাসী” হইয়া পড়িয়াছে। এখন আর আমাদের স্বাধীনতা, ওজস্বিতা বলিয়া কোন বস্তু নাই– এবং তাহা লাভ করিবার প্রবৃত্তি পর্য্যন্ত লক্ষ্যিত হয় না!’

নারীর মনে বদ্ধমূল যেই দাসত্বের মানসিকতা গড়ে তুলেছে হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সেই মানসিকতা থেকে বের হতে পারা নারীদের জন্য খুবই জরুরি। অনেক সময় দেখা যায়, নারীর স্বতন্ত্র স্বাধীন সত্তার বিকাশে নারী নিজেই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই রেফারেন্সগুলো নারীবিরোধীদের খুব উপাদেয়, তাই সুযোগ পেলেই তারা এসব উদাহরণ সামনে এনে হাজির করে। কিন্তু এই অবস্থাটি যে পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে অভ্যস্ততার ভিতর দিয়ে তৈরি হয়েছে সেটা তারা স্বীকার করতে চায় না। মানুষ শৈশব থেকেই যে সংস্কৃতি চলমান দেখে আসে, বিশ্লেষণী মন না থাকলে, বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতা না থাকলে, তাকেই মানুষ স্বাভাবিক ভাবতে শেখে। আর বিশ্লেষণী মন কারো তৈরিই হয় না উপরে উল্লিখিত প্রকৃত শিক্ষা অর্জন না-করতে পারলে।

পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নারীর স্বাধীন সত্তার বিকাশের জন্য প্রাচীন ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন মন-মানসিকতার পরিবর্তন অত্যাবশ্যক, কারণ যেকোনোরকম উন্নয়নের জন্য আগে মানুষের মনের বাধাগুলোই অপসারিত হওয়া দরকার। সনাতনী ভাবধারার বাইরে এসে দাঁড়ানোর জন্য তাই অসচেতন নারীদের আহ্বান জানিয়ে আমরাও বেগম রোকেয়ার ভাষায় বলতে চাই : 

‘অতএব জাগ, জাগ গো ভগিনি!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *