নারীকে অংশগ্রহণের বাইরে রেখে পারিবারিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রসহ সকল পর্যায়ে সিদ্ধান্তগ্রহণের যে সংস্কৃতি দেশে ক্রিয়াশীল আছে, তার বয়স অনেক হলো। এই সংস্কৃতিটিই এখানকার সর্বত্র ব্যাপকভাবে চর্চিত। এটি যে অগণতান্ত্রিক, এটি যে নারীর প্রতি বৈষম্যের বীজ বুনে যাচ্ছে হাজার বছর ধরে–এ ধারণাটিই আমাদের সামনে এসেছে অনেক দেরিতে। এখন জনগণের একাংশ এটা বোঝে ও মানে যে জনগণের অর্ধাংশ নারীর অংশগ্রহণ-ব্যতিরেকে গৃহীত সমস্ত সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক, কিন্তু জনগণের একাংশ সেটা এখনো স্বীকারই করে না। যারা বোঝে ও স্বীকার করে তাদের একাংশ জানা-বোঝা পর্যন্তই থেমে থাকে, এক্ষেত্রে পরিবর্তন আনবার জন্য কোনো উদ্যোগ নেয় না। বাকি একাংশ নারী-পুরুষ জানা-বোঝা ও স্বীকার করার পাশাপাশি এ সংস্কৃতি পরিবর্তনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সচেষ্ট। আশার কথা এই সচেতন অংশে জনমত ক্রমশ বাড়ছে, বাড়ার গতিটা যদিও এখনো আশানুরূপ নয়।
যারা সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণের দাবির পক্ষশক্তি তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। কিন্তু যে বৃহদাংশ মানুষ আজো আগের ধাঁচেই চিন্তা করে, যারা নারীকে আজো ঊনমানুষ বলেই ভাবে, তাদের মানসিকতা পরিবর্তনের কাজটি ব্যাপকভাবে শুরু করা না-গেলে সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণের দাবিটি দাবি হয়েই থেকে যাবে আরো দীর্ঘকাল। এ অবস্থা আমাদের আশান্বিত করে না।
বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত দেখতে পাওয়া যায়, তা সংখ্যাটা যত ক্ষুদ্রই হোক। অর্থাৎ আমাদের একাংশ নারী আজ কেবল প্রজনন ও গার্হস্থ্যকর্মে নিয়োজিত থেকেই জীবন পার করছেন না। তাঁরা সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। চিরাচরিত কাজের বাইরে অপ্রথাগত কাজে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করছেন। এ অংশের অপ্রথাগত কাজে যুক্ততা সমাজচক্ষুর কাছে ক্রমশ সয়েও আসছে। নারীসমাজের এ অংশ আমাদের অগ্রবর্তিকা। তাদের দেখে অন্য নারীরা যেমন নিজেদের ওই অবস্থানে বা তার চেয়েও উচ্চস্তরের অবস্থানে অধিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতে পারছে; তেমনি নারীবিরোধী গোষ্ঠীর মধ্যেও একটা সহনশীলতা তৈরি হচ্ছে। এই অবস্থাটিকে কাজে লাগাতে পারলে হয়ত আমরা নারীবিরোধী শক্তির জারিজুরিকে ক্রমশ দুর্বল করে দিতে পারব।
বর্তমানে আমাদের একটা বড়ো অগ্রগতি হলো সমাজে নারীর কীর্তির উদাহরণ স্থাপিত হওয়া, যেটা আগে বিদ্যমান ছিল না। ভারতবর্ষের অবরোধবাসিনী নারীদের মুক্তির জন্য আমাদের এখানে প্রাতঃস্মরণীয় যেসব নারী-পুরুষ কাজ করেছেন, তাঁদের চাইতে আমাদের সময়ে এসে নারীর পক্ষে কাজ করা অনেক সহজ হয়েছে। আমরা এখন যুক্তির পাশাপাশি সামনে উদাহরণ নিয়ে কথা বলতে পারি। তাঁদের সময়ে ভরসা ছিল কেবল যুক্তি। কিন্তু অপেক্ষাকৃত অনুকূল পরিস্থিতিতে আমাদের অর্জন, তাঁদের অর্জনের চেয়ে বেশি কি না, সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
এটা অনস্বীকার্য যে, সব কাজে নারীকে যুক্ত করার দৃশ্য-অদৃশ্য সমস্ত বাধা অপসারণ, নারীর অগ্রগতির পথের প্রতিবন্ধকতাসমূহকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া, সমুদয় সম্ভাবনা নিয়ে নারীর বিকশিত হবার সুযোগ উন্মোচিত করার প্রয়োজন আছে এবং এটা করার দায়িত্ব রাষ্ট্র, সরকার ও তার নাগরিকগণসহ সবার। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অ্যাকাডেমি, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সংগঠন ও একক ব্যক্তির কেউই এ দায়িত্ব এড়াতে পারে না। কিন্তু আমাদের প্রবণতার মধ্যে কমবেশি এই বোধবুদ্ধির অনুপস্থিতি আছে। আমরা যতটা অন্যের দায়দায়িত্ব পালন করা না-করার সমালোচনায় আগ্রহী, নিজ দায়িত্ব পালনে ততটা আগ্রহী নই। সমস্ত কাজই সরকার করবে বলে যারা আশা করে, তারা নিজেদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে অন্ধকারে আছে বলে মনে হয়। বস্তুত তারা এটা বলতে পেরেই খুশি যে সরকার তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে ও হচ্ছে। এটা বলার সময় তারা একেবারেই মনে রাখে না যে, তার/তাদের নিজেদেরও এক্ষেত্রে দায়িত্ব আছে, যা তারা পালন করবার কথা ভাবে না পর্যন্ত। এ অবস্থাটিও আমাদের জন্য বিশেষভাবে সুখকর নয়।
সচেতনভাবে ভাবলেই এটা বোধগম্য হয় যে, প্রজনন ও গার্হস্থ্য কাজের ভার চাপিয়ে আমাদের পুরুষকুল তাদের নিকট-সম্বন্ধীয় নারীদের সবকিছু থেকে দূরে রাখতে দিনের পর দিন কীভাবে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে চলেছে। নিজেরা করতে পারে এমন কাজেও যখন তারা স্নেহের দাবিতে তাদের মাকে ব্যস্ত রাখে, ভালোবাসার দাবিতে বউ ও বোনকে ব্যস্ত রাখে, তখন যে তার/তাদের সুখের জন্য তারা মা-বউ-বোনের কতকটা অ-সুখেরও কারণ হয়, সেটা ভাববার মতো দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় ক্ষেত্রে অনেক সচেতন মানুষের মধ্যেও অনুপস্থিত দেখা যায়। আমরা মনে রাখি না যে, কাজের পাশে বিশ্রাম আমাদের মা-বউ-বোনেরও দরকার, সংসারের বাইরের বিষয়-আশয় নিয়ে ভাববার ও সেসবে যুক্ত হবার অধিকার তাদেরও আছে। গান শোনা বা করা, শিল্প-সাহিত্যকর্মের সাথে যুক্ত হওয়া, নাটক-সিনেমা দেখা ও করার মতো সুকুমারবৃত্তি বা খেলাধুলা দেখা ও করা কিংবা বেড়াতে যাওয়ার মতো বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়া তাদের জন্যও দরকারি। নারী হয়ে জন্ম নিলে বাড়িঘরের কাজে জীবন দিয়ে দিতে হবে; সন্তানধারণ, জন্মদান ও লালনপালন করেই সব পেয়েছির তৃপ্তি পেতে হবে–এরকম চাওয়াটাই অগণতান্ত্রিক। এই অগণতান্ত্রিক অবস্থাটার চর্চা আমরা জেনে-না-জেনে, ভেবে-না-ভেবে নিতান্ত অভ্যস্ততা থেকে করি। এই অভ্যস্ততা থেকে আমাদের সবারই বের হয়ে আসতে হবে। তা নইলে বিশ্রামের সুযোগ না-দিয়ে আমাদের ভাইয়েরা তাদের মায়েদের সংসারের ঘাঁনির নিচে আত্মোৎসর্গ করতে বরাবরই ইন্ধন দিয়ে যেতে থাকবে, সামাজিক-অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত হবার সুযোগ না-দিয়ে তাদের স্ত্রীদের একের পর এক সন্তান জন্মদান ও তার লালনপালনের কাজে মহিমা আরোপ করে যেতে থাকবে, পড়াশোনা করে বড়ো হবার পথ করে না-দিয়ে তাদের বোনেদের তারা পরিবারের সবার ফুটফরমাশ খেটে তৃপ্ত থাকতে বলবে। সচেতনভাবে ও অসচেতনভাবে, যেকোনো অবস্থা থেকেই হোক আমাদের এরকম ভাবনা ও কাজই নারীদের রাষ্ট্রের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে এবং সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য দৃশ্যমান ও তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে দিচ্ছে না; বরং বড়ো ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। এই প্রথার খড়্গেই যুগ যুগ ধরে বলি হয়ে আসছে আমাদের অর্ধাংশ নারী। আজ এ প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে, তা নইলে আমাদের দিন বদলের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না–না ব্যক্তির, না সমাজের, না রাষ্ট্রের।
নারীদের একের পর এক সন্তান জন্মদানে বাধ্য করে আমাদের সমাজ কেবল যে নারীদের বিকাশকেই রহিত করে চলেছে তা নয়, বরং এর মাধ্যমে একইসঙ্গে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও ক্ষতি করে চলেছে। সন্তানধারণ, সন্তান জন্মদান ও লালনপালনের ভার কম থাকলে যেকোনো নারী প্রজননকর্মের বাইরে অন্য কাজে বেশি সময় দিতে পারে। পরিবারের অর্থনীতির ওপরে যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাছাড়া তাদের শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকায় তারা কম অসুস্থ হয়। পরিবারে সন্তানসংখ্যা কম থাকলে তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় কম হয়, সবিশেষ এদের ঠিকভাবে মানুষ করে তোলারও অবকাশ তৈরি হয়। আর এ ধরনের পরিবার যে সমাজে বেশি, সে সমাজ হয় তত উন্নত, তত অনুসরণীয়। এর সুফল রাষ্ট্রের ভাগেও বর্তায়। অতিরিক্ত জনসংখ্যার ভারে রাষ্ট্রকে কাবু হতে হয় না। জনগণের অতিরিক্ত চাপ রাষ্ট্রের জল-জমি-পরিবেশের ওপর যে চাপ ফেলে, জনসংখ্যা পরিমিত হলে সে চাপ সংগত কারণেই কম হয়। রাষ্ট্র মনোযোগী হতে পারে জনগণকে জনসম্পদে উন্নীত করায়।
এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, পরিবারে যদি গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ তৈরি করা যায়, তাহলে পরিবারপিছু সন্তানসংখ্যা অনেক কমে যাবে। কারণ কোনো মা-ই চায় না তার প্রজননসক্ষমকালের পুরোটা জুড়ে কেবল একের পর এক সন্তান জন্ম দিয়ে যেতে। এর ফলে তাদের শরীর, মন ও পরিবারের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর কীরকম কুপ্রভাব পড়ে তা তারা জানে। তাছাড়া তাদের জীবনটা যে এতে রান্নাঘর, শোবার ঘর আর বাড়ির আঙিনার মধ্যেই নিঃশেষিত হয়ে যায়, তা-ও তারা জানে।
স্বামী-স্ত্রী ও অন্য সদস্যের মধ্যে পরিবারে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা হলে তা সন্তানসংখ্যার ওপরে প্রভাব রাখা ছাড়াও ওই পরিবারের সকল শিশু ও কিশোর-কিশোরীর মধ্যেও এর ইতিবাচক ছাপ পড়ে। আজকে যারা শিশু ও কিশোর-কিশোরী এরাই আগামী দিনে দেশের সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিবে। পরিবার থেকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সম্পর্কের ধারণা পেলে পরবর্তী জীবনেও তারা এর চর্চা করবে। তাতে সর্বত্র গণতন্ত্রের চর্চা হবার সম্ভাবনা তৈরি হবে। গণতন্ত্রচর্চার দায় কেবল রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতাদের নয়, এ দায় সবারই।
এই দর্শন থেকেই আমাদের চাওয়া এরকম যে, আমাদের পরিবারের পুরুষকর্তারা সচেতনভাবে প্রজনন ও গার্হস্থ্য কর্মভারে পীড়িত তাদের মা-বউ-বোনেদের ওপরে পরিবারের গার্হস্থ্যকর্মের সমুদয় ভার না-চাপিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নিজেরাও ভাগ করে নেবে। যতদিন সেটা না-হচ্ছে ততদিন অনেক দূরে ও উচ্চে লক্ষ্য স্থির রেখে সেই লক্ষ্যে নিজেকে এগিয়ে নিতে পরিবার থেকে চাপিয়ে দেয়া অনাবশ্যক ভারকে যেন মেয়েরা ‘না’ বলতে শেখে। ঝামেলা এড়িয়ে এই ‘না’টা যেন যুক্তির সাথে বলা যায়, তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এ ধরনের প্রস্তুতি নিতে মেয়েদের সহায়তা করতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি সংস্থা।
সমাজের যে রক্ষণশীল অংশ নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস না-করে নারীকে পুরুষের মনোরঞ্জনের উপকরণ মনে করে, তারা এই প্রত্যাশিত সংস্কৃতির বিরোধিতা করবে তাতে সন্দেহ নেই। তাদের এই বিরোধিতাকে প্রতিহত করতে প্রাতিষ্ঠানিক-সামাজিক-রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা অব্যাহত রাখতে হবে। তারা না-চাইলেও সমাজ যে বদলাচ্ছে ও বদলাবে, এই অনিবার্যতাকে বুঝতে সহায়তা করতে হবে। সে লক্ষ্যে কোথাও আমাদের পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেই। তদুপরি কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রয়োজনে এই শ্রেণির অযৌক্তিক চাওয়ার প্রতি সাড়াপ্রদান এদের শিকড়কে হয়ত আরো ভিত্তি দিচ্ছে, যা আশঙ্কাজনক। আমাদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি।
আমাদের লক্ষ্য একটা অর্থবহ গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ, যেখানে সব কাজে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ থাকবে। যেখানে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য বিলুপ্ত হবে, কারো সুখ যেখানে অন্য কারো অ-সুখের কারণ হবে না। এই অবস্থায় উপনীত হবার জন্য আমাদের খোলামনে ভাবতে ও কাজ করতে হবে। তাহলেই হয়ত আমাদের সামনে অপেক্ষা করবে এমন একটা আলোকিত ভবিষ্যৎ, যা হয়ত আন্তর্জাতিক নারীদিবসের জন্য ২০১২ সালের স্লোগান হিসেবে ‘কানেকটিং গার্লস, ইন্সপায়ারিং ফিউচার : কিশোরী সব মিলাও হাত, ভবিষ্যতের ঘোচাও রাত’কে নির্ধারণ করে জাতিসংঘ যে ধরনের ভবিষ্যতের কথা বলতে চেয়েছে, তাতে পৌঁছুতে আমাদের সহায়তা করবে।